বাংলাদেশে হাদিস চর্চার ইতিহাস উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

সম্মানিত পাঠক! আজ আমরা বাংলাদেশে সর্বপ্রথম হাদিস শিক্ষা কেন্দ্র ও বাংলাদেশের কোথায় প্রথম ইলমে হাদিসের কেন্দ্র গড়ে উঠে তা নিয়ে আলোচনা করব। আমরা বিষয়টি বিস্তারিত তুলে ধরব এবং সঠিক ইতিহাস আপনাদের সাথে শেয়ার করব। ইনশাআল্লাহ! আপনারা সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন। 

বাংলাদেশে হাদিস চর্চার ইতিহাস

বাংলাদেশে হাদিস চর্চার শুরুর কথা

বাংলার প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁ। মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যা বিধৌত এই সোনারগাঁ।মধ্যযুগীয় রাজধানী সোনারগাঁয়ের চারপাশের (বহতা) নদীগুলো ছিল জোয়ারের উচ্ছ পানিতে প্রাণবন্ত। মধ্যযুগীয় ‘জান্নাতুল বিলাদ' [স্বর্গের শহর] এই সোনারগাঁকে কেন্দ্র করে বাংলার রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প ও চারুকলা আবর্তিত হয়েছিল। ঝোপঝাড়ের আড়ালে কালের করাল গ্রাস এড়িয়ে বিধ্বস্ত ঐতিহ্যে সামান্য চিহ্ন মাত্র এখন বিদ্যমান । 

বিচূর্ণ ইটের পাঁজরের পুরু আস্তরণে জমাট বাঁধা সেই আভিজাত্যের ছাপ মুছে যাওয়ার পথে। বাংলার প্রাচীন রাজধানী, বার ভূঁইয়ার অবস্থান, আজম শাহ ও ঈসা খাঁর সোনালি রাজত্ব, ইরানি মহাকবি হাফিজের কাব্য উপহার, বিশ্বপর্যটক ইবনে বতুতার আগমনসহ নানাবিধ ঐতিহ্যের কারণে গর্বিত এই সোনারগাঁ। এই সুবর্ণ গ্রাম । তবে সোনারগাঁয়ের ভূমি গর্বিত হয়েছে ভিন্ন আরেকটি কারণে। সেটা হচ্ছে মধ্যযুগীয় বিখ্যাত হাদীস বিশারদ শায়েখ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা র.- এর মহাআগমন ।

আগমনের সূচনা কথা

আরব ভূমিতে ইসলামের আলো বিকশিত হওয়ার ঊষালগ্ন থেকেই এই ভারত ভূমিতে ইসলামের আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে পড়ে। আরব মুবাল্লিগ-বণিকরা ইসলাম প্রসারে ব্রত হন। তবে তা পূর্ণতা পায় ১০০৫/৩ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদদীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বাংলা বিজয়ের মধ্য দিয়ে । এর পর নবদ্বীপ, গৌড় ইত্যাদি এলাকায় মুসলিম সালতানাতের ভিত্তি মজবুত হলেও পূর্ববঙ্গে তখনও সেন, দেবরাজ বংশের রাজারা শাসন করছে। এদিকে দিল্লীর মসনদে তখন আসীন প্রবল পরাক্রমশালী সম্রাট গিয়াসুদ্দীন বলবন। 

১২৭০ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁ বলবনের অধীনে চলে যায়। সোনারগাঁয়ে বলবনী রাজত্ব শুরু হলে এ এলাকায় জ্ঞাণী-গুণী, সুফি-সাধকদের আগমন বৃদ্ধি পেতে থাকে। জ্ঞাতব্য যে, দ্বাদশ শতাব্দীর কিছুটা আগে ও পড়ে সুফি-সাধকরা মধ্য এশিয়ার জ্ঞান-বিজ্ঞানের তীর্থকেন্দ্রগুলো আর ধরে রাখতে পারেনি। ক্রমাগত মোগল আক্রমণে বিধ্বংস্ত এই নগরীর সাধকেরা তৎকালীন স্বর্গভূমি ভারতবর্ষের দিকে যাত্রা শুরু করেন। এই প্রেক্ষিতে বলবনী রাজত্বকালে মধ্য এশিয়া থেকে দিল্লিতে আগমন করেন ইসলামি চিন্তাবিদ ও বিখ্যাত হাদীসবিশারদ শায়েখ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা রহ. । 

দিল্লীতে আসার পর তাঁর যশ-খ্যাতি দিগ্বিদিক ছড়িয়ে পড়ে। জনপ্রিয়তায় তিনি সম্রাটকেও অতিক্রম করেন। ফলশ্রুতিতে সভাসদদের আক্রোশে সুলতান আবু তাওয়ামা রহ. কে সোনারগাঁ সফর করতে অনুরোধ করেন। 

সোনারগাঁয়ে যাত্রা ও প্রথম হাদীস শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন : 

তারপর আবু তাওয়ামা রহ. একটি ছোট্ট দল নিয়ে তৎকালীন ভারতের দুর্গম সোনারগাঁয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন।

দিল্লি থেকে সোনারগাঁ আসা তখন সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না। পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল পাড়ি দিয়ে পৌছা বেশ শঙ্কাপূর্ণ ছিল। দীর্ঘ পথ চলার পর এই ক্ষুদ্র কাফেলাটি বিহারের ‘মানের' প্রদেশে এসে এক বাড়িতে রাত্রিযাপন করে। বাড়ির কর্তা আবু তাওয়ামা রহ. এর জ্ঞান-গরিমা দেখে মুগ্ধ হয়ে শায়েখের গৃহত্যাগ প্রাক্কালে আপন পুত্ৰ ইয়াহইয়া মানোরিকে খাদেম হিসেবে উপহার দেন। এই খাদিমই পরবর্তীতে হযরতের শ্রেষ্ঠ শিষ্যে পরিণত হন । দীর্ঘ সফরের পর ১২৭৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলার পূর্বাঞ্চল সোনারগাঁয়ে এসে পৌঁছালেন। মোগরাপাড়া নিকটস্থ দক্ষিণ দিকে অবস্থান গ্রহণ করেন। চারদিকে তাঁর যশ-খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। দলে দলে মানুষ তাঁর সান্নিধ্য অর্জনে ছুটে আসে। আবু তাওয়ামা রহ. এখানে খানকা পত্তন করেন। সেই সাথে একটি শিক্ষাকেন্দ্রও স্থাপন করেন। 

এখানে হাদীসের বিশুদ্ধ কিতাবদ্বয় বুখারী ও মুসলিমসহ অন্যান্য হাদীসগ্রন্থ শিক্ষাদানে ব্রত হন। ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করেছেন যে, এটিই হচ্ছে উপমহাদেশে প্রথম হাদীস চর্চার শিক্ষা কেন্দ্র। আবু তাওয়ামা রহ এখানে হাদীসচর্চার পাশাপাশি অত্যন্ত সফলভাবে জৌতির্বিদ্যা, গণিত ভূগোল, চিকিৎসা, রসায়ন, সুফি-সাহিত্য, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজীত শিক্ষার প্রবর্তন করেন। 

এভাবে এই বিদ্যাপীঠের ছাত্রদের আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধনেও তিনি সচেষ্ট ছিলেন। এই বিশাল এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এই মাদরাসায় শিক্ষার্থীরা একত্র হন। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পূর্ব পুরুষরাও এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন।

সুলতান আবু তাওয়ামা রহ. এর মৃত্যু

দীর্ঘ ২৩ বছর অধ্যক্ষ ও অধ্যাপনার দায়িত্ব পালন করে এই মহান সাধক ১৩০০ [সম্ভবত) খ্রিষ্টাব্দের দিকে ইন্তিকাল করেন। আবু তাওয়ামা রহ. এর সুযোগ্য শিষ্যরা কয়েক যুগ ধরে তাঁর মিশনকে সুচারু রূপে আঞ্জাম দেন। কিন্তু নামা অসংগত কারণে কালক্রমে তা ইতিহাসের পাতায় স্থান নেয়। মধ্য যুগ শেষে আসে আধুনিক যুগ। সব জায়গায় নতুনত্বের ছাপ পরিলক্ষিত হয়। কথিত আভিজাত্যের দাপটে সেই পুরনো ঐতিহ্য বিচূর্ণ ভগ্ন ইটের নীচে চাপা পড়ে। আর এই অধীবাসীরাও সেই ঐতিহ্যকে বুকে ধারণ করার কষ্ট স্বীকার করতে অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে।

নতুন আলোকচ্ছটার শুভাগমনঃ

দীর্ঘ দিন হল; প্রায় ৭০০ বছর। হঠাৎ ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে একটি নতুন আলো এ আধারাচ্ছন্ন ভূমিকে আলোকিত করল। যেমন করেছিলেন আবু তাওয়ামা রহ.। এবারও এই মনীষী এলেন দিল্লী থেকে। তিনি এলেন নাড়ির টানে । তিনি এসে কোন বাহ্যিক খানকা, শিক্ষাকেন্দ্র বা একাডেমি স্থাপন করেননি। তবে আমাদের অন্তরে চেতনার মশাল প্রজ্বলিত করেছেন। নবাগত জীবিত মণীষী মৃত মনীষীর কবরের পাশে ফাতিহা পাঠ করলেন । তাঁকে শ্রদ্ধা জানালেন । হৃদয়ের নীরব ভাষায় মাটির নিচের সাধককে বললেন, 'হযরত'! আমাদের ক্ষমা করুন, অধমরা পারিনি আপনার চিন্তা-চেতনা, শিক্ষা-দীক্ষাকে জীবন্ত রাখতে। আপনার পদচিহ্ন হিফাযত করতে।' এরপর নবাগত মণীষী চলে গেলেন সেই দিল্লী ।

 তিনি আর আবু তাওয়ামা রহ.-এর মতো থাকলেন না। তবে থাকল তার পদস্পর্শিত পূণ্য মাটি। আরো থাকলো তাঁর হৃদয়নির্গত আবেগ-ব্যাকুলতা আশেপাশের কিছু খাদিমের হৃদয়ের বদ্ধ মণিকোঠায়। তিনি প্রেরণা দিলেন, শক্তি দিলেন, অর্থ দিলেন হারানো ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে। ফলশ্রুতিতে আবু তাওয়ামা রহ. এর নামে অদূরেই একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মিত হল, যা মূলত চিন্তা-দর্শন ও আদর্শের ক্ষেত্রে পুরনো প্রথম প্রতিষ্ঠানের প্রতিকৃতি ও পুনঃজীবন। 

এর মূল প্রতিষ্ঠাতা মধ্যযুগীয় মহান সাধক ও হাদীসবিশারদ আবু তাওয়ামা রহ. এবং নতুন প্রতিষ্ঠাতা এই নবাগত মনীষী । প্রিয় পাঠক! সেই নবাগত মনীষী হচ্ছেন বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ইসলামি চিন্তাবিদ, যুগ সংস্কারক আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.

ভারতবর্ষে আগমনকারী সাহাবীগণ

  • হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উতরাহ রা. 
  • হযরত আসিম বিন আমর আত-তামীমী রা. 
  • হযরত সুহাব ইবনে আল-আবদী রা. 
  • হযরত শুয়াইব বিন আদী রা.
  • হযরত আল-হাকাম ইবনে আবিল আস-সাকাফী রা.
  • হযরত ওসমান রা. এর আমলে
  • হযরত উবায়দুল্লাহ ইবনে মা'মার আত-তামীমী
  • হযরত আব্দুর রহমান ইবনে সামুরা রা.
  • হযরত মুয়াবিয়া রা. এর আমলে
  • হযরত সিনান ইবনে সালমাহ ইবনে আল-মুহাব্বিক আল-হুয়ালী রা.



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন