মাওলানা শাহ জমির উদ্দিন নানুপুরী রাহ. জীবন ও কর্ম

প্রিয় পাঠক! আজ আমরা শাইখুল মাশায়েখ কুবে যামান মাওলানা শাহ জমীর উদ্দীন নানুপুরী (রহ.) এর চমৎকার ও বর্ণাঢ্য জীবন নিয়ে একটি আর্টিকেল শেয়ার করছি। আশা করি এই একটি আর্টিকেলেই আপনারা হযরতের জীবনের সম্পূর্ণ দিকটা পেয়ে যাবেন। ইনশাআল্লাহ।

মাওলানা শাহ জমির উদ্দিন নানুপুরী রাহ. জীবন

মাওলানা শাহ জমির উদ্দিন নানুপুরী রাহ

শাইখুল মাশায়েখ কুবুল আলম মাওলানা শাহ জমীর উদ্দীন নানুপুরী (রহ.) ছিলেন লক্ষ লক্ষ মানুষের আধ্যাত্মিক মুরুব্বী । ইছলাহ ও ছুলুকের উজ্জ্বল নক্ষত্র । আরব-আযমে যার অগণিত অসংখ্য ভক্ত-অনুরক্ত। যুগে যুগে আল্লাহ তা'য়ালা তার বান্দাদের হিদায়াত ও কল্যাণে চুলাহাদের প্রেরণ করেন। পথভোলা মানুষের রাহবারীর জন্য রাহবার পাঠান । 

হযরত নানুপুরী (রহ.) ছিলেন সেই ক্ষণজন্মা ব্যক্তিদের একজন। যার বিয়োগে ব্যক্তি বা গোষ্ঠি নয় বরং গোটা দেশের ঈমানদারগণ শোকাহত। দেশের বাহিরেও শোক ছায়া নেমেছিল অগণিত মুমিনের হৃদয়ে । পহেলা রবীউল আওয়াল ১৪৩২ হিজরী মোতাবেক ৫ ফেব্রুয়ারী ২০১১ইং রোজ শনিবার রাত প্রায় ১১ টায় সকলকে শোক সাগরে ভাসিয়ে তিনি আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেলেন-

انا لله وانا اليه راجعون

অর্থ : নিশ্চয় আমরা সকলে আল্লাহ তা'য়ালার জন্য এবং আমরা আল্লাহর নিকটেই ফিরে যাব ।

হযরত (রাহ.) প্রায় প্রত্যেক দুআতে মন্দ মওত থেকে পানাহ চাইতেন । আর তা এমনই কবুল হল যে, বড় ঈর্ষণীয় মওত নসীব হল । ৩-৪ ফেব্রুয়ারী ২০১১ ইং রোজ বৃহস্পতি ও শুক্রবার নানুপুর মাদরাসার বাৎসরিক মাহফিলে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম । তিনি অত্যন্ত সু-শৃঙ্খলভাবে মাহফিলের যাবতীয় কাজ পরিচালনা করলেন । 

শুক্রবার সকালে দীর্ঘক্ষণ দরদমাখা কণ্ঠে নছিহত করলেন । সভা শেষ হল । অধিকাংশ লোক বাড়ীতে রওনা হলেন । আমরাও আব্বাজানের (ডি,আই,টির হযরত মাও: আবদুল আউয়াল সাহেব দা: বা:) সাথে নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম । অনেক মেহমান তখনও থেকে গেলেন । অনেকে পরদিন সকাল বেলা হযরতের কাছ থেকে দোআ নিয়ে যার যার বাড়ীমুখী হলেন । হযরত শনিবার ৫ ফেব্রুয়ারী ২০১১ইং এশার নামায জামাতের সাথে আদায় করলেন । নামায শেষে তালিবানে ইলমের উদ্দেশ্যে বয়ান করলেন । বয়ানের এক পর্যায়ে বলেন, এমন আদনা কামও করবে না, যার কারণে মন্দ মওত হতে পারে, আবার এমন আদনা কামও তরক করবে না যার দ্বারা উত্তম মওত নছীব হতে পারে । বয়ান ও দোয়ার পর কামরায় এসে রাতের উপস্থিত খাবার গ্রহণ করলেন ।

 অযিফা আদায় করে বিশ্রাম নিলেন । হঠাৎ অস্থিরতা অনুভব করলেন। বিছানা ত্যাগ করে নিজেই অযু-তাহারাত হাছিল করলেন। সংবাদ পেয়ে হযরতের সাহেবজাদাগণ ছুটে এলেন। এ্যাম্বুলেন্স আনতে চাইলেন । হযরত নিষেধ করে বললেন দরকার নেই। যিকরুল্লাহ জারি ছিল । এরপর দশ মিনিটেরও কম সময়ে রওনা হয়ে গেলেন এবং রফীকে আ'লার সান্নিধ্যে পৌঁছে গেলেন । সাড়ে ১১টার দিকে আমরা খবর পেলাম । নানুপুর থেকে মাহফিল শেষ করে এসে এখনো আমাদের সফরের ক্লান্তি কাটেনি । সাথে সাথে আব্বাজানকে ফোন করলাম ।

 তিনি কাঁদছেন। বললেন, দেরী কর না । যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রওনা হব । এর পর আমরা কয়েকজন আব্বাজানের সাথে নারায়ণগঞ্জ ডি, আই, টি মসজিদের সামনে থেকে রাতেই রওনা হলাম । সকালে নানুপুর মাদরাসায় পৌঁছে শোকের যে করুণ দৃশ্য দেখলাম তা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয় । মানুষ কাঁদছে আর চোখের পানি মুছছে। এ ছিল আল্লাহর জন্য মুহাব্বতের অপূর্ব দৃশ্য ।

মৃত্যুর সময় হযরতের বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর । তিনি স্ত্রী সহ সাত ছেলে ও এক মেয়ে রেখে যান । ৬ই ফেব্রুয়ারীর বিকেলে মাদরাসা ময়দানে নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হয় । জানাযার নামাযের ইমামতি করেন দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার প্রধান পরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফী (দা.বা.)। লক্ষাধিক ভক্ত-অনুরক্ত, আলেম-উলামা, পীর মাশায়েখ, সমাজের গণ্য-মান্য ব্যক্তিবর্গ সহ সাধারণ মানুষ জানাযার নামাযে শরীক হন ।

 এ বিপুল সমাবেশ হযরতের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ বহন করে । জানাযা নামাযের পূর্বে দেশের শীর্ষ উলামা-মাশায়েখ বক্তব্যে বলেন, হযরত মাওলানা শাহ জমীর উদ্দীন নানুপুরী (রহ.) আল্লাহ তা'য়ালার ডাকে চলে গেছেন তবে তিনি যে আদর্শ এবং দ্বীনী মিশন রেখে গেছেন আমাদের উচিৎ সে মিশনকে এগিয়ে নেয়া । আদর্শকে ধরে রাখা । আয় আল্লাহ তুমি আমাদের তৌফিক দাও। হযরতকে পরম সুখে জান্নাতের বুলন্দ মাকামে আশ্রয় দাও । আমীন!

জন্ম ও বংশ পরিচয় 

এই ক্ষণজন্মা মহাপরুষ ১৯৩৫ সালে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ফটিকছড়ি থানার অন্তর্গত সুপ্রসিদ্ধ নানুপুর গ্রামে এক দ্বীনদার প্রভাবশালী অভিজাত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন- পিতা ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল গফুর সাহেব । সম্মানিতা মাতা আমেনা বেগম । পিতা মাতা উভয়ে ছিলেন অত্যন্ত শরীফ, ধর্মপরায়ণ পরহেজগার। দাদাজান জনাব নিয়ামত আলী, পরদাদা ছিলেন প্রতাপশালী ব্যক্তিত্ব জনাব হিম্মত আলী ।

শিক্ষা জীবন

প্রাণপ্রিয় পিতা-মাতার নিকট হতে প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা হয় । প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় স্থানীয় মক্তব ও মাদরাসা থেকে । অতঃপর তিনি উপমহাদেশের অন্যতম বিদ্যাপীঠ আল জামিআতুল আহলিয়াহ দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসায় ১৯৫০ সনে জামাতে দাহমে ভর্তি হন । এরপর কঠোর সাধনার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ শিক্ষা সফরের সমাপ্তি ঘটে । ১৯৬০ ঈসায়ী সনে সুনামের সাথে দাওরায়ে হাদীস উত্তীর্ণ হন । হযরত ইলমে ইলাহী অর্জনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করে গভীর রাত পর্যন্ত কিতাব অধ্যয়ন করতেন । নিয়মিত দরসে উপস্থিত থাকতেন । তাহাজ্জুদ আদায় করতেন । 

হাটহাজারী মাদরাসার স্বনামধন্য মুহাদ্দিস হযরতের সহপাঠী হযরত মাওলানা শামসুল আলম সাহেব (দা.বা.) বলেন, তিনি ছাত্র যামানায় অত্যধিক নম্র-ভদ্র ছিলেন। সর্বদা, লেখাপড়া ও ইবাদতে লিপ্ত থাকতেন। আমরা তাকে কখনো কোন বেহুদা ফাহেশা কাজ অথবা গল্প গুজবে লিপ্ত হতে দেখিনি । তাঁর সততা, নিষ্ঠা ও চারিত্রিক মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে জামেআর সকল উস্তাদগণ তাকে আন্তরিকভাবে মহব্বত করতেন। সময় সুযোগ পেলেই তাকে দেখতাম মাদরাসার খেদমত করতে, উস্তাদদের খেদমত করতে। তিনি যে অদূর ভবিষ্যতে আধাত্মিক জগতের রাহবার হবেন তখন থেকেই আমরা সে নিদর্শন তার মাঝে সুস্পষ্ট দেখতে পেয়েছি ।

ইলমে দ্বীনের খিদমতে আত্মনিয়োগ

আল্লামা শাহ জমীর উদ্দীন নানুপুরী (রহ.) শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করে চট্টগ্রামের নজুমিয়া হাটের বাতুয়া কওমী মাদরাসায় শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন । সেখানে তিনি শরহে জামী, সুল্লামুল উলূম, মাইবুযী, তাফসীরে জালালাইনের মত গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদী সুনামের সাথে পড়াতে থাকেন । ১৯৬৫ সালে তিনি ঐতিহ্যবাহী নানুপুর জামিয়া ইসলামিয়া ওবায়দিয়া মাদরাসায় কুতুবে আলম হযরত মাওলানা শাহ সুলতান আমহদ নানুপুরী (রহ.) এর নির্দেশে শিক্ষক হিসাবে যোগদেন । শুরু হয় হযরতের জীবনের নব অধ্যায় । নিজ গ্রামের মাদরাসায় মনপ্রাণ উজার করে তালীম তরবিয়তে আত্মনিয়োগ করেন । মাদরাসার সার্বিক কল্যাণে মেহনত শুরু করেন । 

১৯৮৫ সালে তিনি জামেয়ার প্রধান পরিচালক পদে অভিষিক্ত হন। কুতুবে যামান হযরত মাওলানা শাহ জমীরউদ্দীন নানুপুরী (রহ.) এর ২৫ বছরের বলিষ্ঠ ও গতিশীল নেতৃত্বে, মুখলেছানা মুজাহাদায় জামিয়ার অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন হয় । নতুন বিভাগ চালু, তালিবে ইলমের সংখ্যা বৃদ্ধি ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঈর্ষণীয় পর্যায়ে পৌঁছে । হযরত রহ. জীবনে বহু মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন । অনেক মাদরাসার শুরার প্রধান ছিলেন । 

প্রায় ৪০০ (চার শত) মাদরাসা হযরত রহ. এর পরামর্শে চলতো । দরস ও তাদরীসের পাশাপাশি হযরত রাহ. ছিলেন একজন খ্যাতিমান মুখলিস দাঈয়ে ইসলাম, সুমিষ্টভাষী ওয়ায়েজ। দূর দূরান্ত থেকে মানুষ হযরতের বয়ান শোনার জন্য আসত । হযরতের বয়ান ছিল দালিলিক, তথ্যপূণ্য। হৃদয়ে দাগ কাঁটতো। চোখে অশ্রু ঝরাতো । হিদায়াতের আলোয় দিল ও দেমাগ উদ্ভাসিত হতো । দ্বীনের দাওয়াতের লক্ষ্যে হযরত মাওলানা শাহ্ জমীর উদ্দীন নানুপুরী (রহ.) ছিলেন দক্ষ কলম সৈনিক । 

টানা দীর্ঘ বৎসর পর্যন্ত তিনি ছিলেন নানুপুর জামিয়া ওবাইদিয়ার মুখপত্র মাসিক আর-রশিদ এর স্বনামধন্য সম্পাদক । আমাদের দেশে প্রকাশিত মাসিক দ্বীনি পত্রিকাগুলোর মধ্যে মাসিক আর-রশিদ ছিল প্রথম সারির পুরাতন পত্রিকা, যা বহু মানুষের দ্বীনি বিষয়ে জ্ঞানার্জনের চাহিদা পূরণ করছে ।

আধ্যাত্মিক রাহবার

চেরাগ থেকে চেরাগ জ্বলে, হৃদয় থেকে হৃদয় আলো গ্রহণ করে । কুদরতের এক অমোঘ নীতি হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) এর বিশিষ্ট খলীফা হযরত খাজা আজিজুল হাসান মজযুব (রহ.) বলেন, আল্লাহর প্রেমে বিদগ্ধ হৃদয় ও আগুনের একই বৈশিষ্ট্য।  একটি জ্বলে ঘর থেকে ঘরে, অপরটি হৃদয় হতে হৃদয়ে ।

আমাদের ভারত উপমহাদেশে ইলম ও আমলের রাহনুমায়ী করেছেন অসংখ্য নায়েবে নবী । হিদায়াতের পথ দেখিয়েছেন অসংখ্য আলেমে রব্বানী । আমাদের নিকট অতীতে তাদের অন্যতম ছিলেন ইমামে রব্বানী হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রহ. (১২৪৪-১৩২৩ হি.)। হযরতের ফয়েয প্রাপ্তদের অন্যতম ছিলেন হাটহাজারী মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতাদের একজন বহুমুখী আত্মিক ও বাহ্যিক জ্ঞানের এক বিরল ব্যক্তি হযরত মাওলানা জমীর উদ্দীন চাটগামী রহ. (১২৯৬-১৩৫৯ হি.)। 

তাঁর আলোক সান্নিধ্য থেকে আলো গ্রহণকারীদের বিশিষ্ট একজন হলে ইমামুল আরেফীন পটিয়ার মুফতী আযীযুল হক রহ. (মৃত্যু ১৩৮০ হি.)। তারই ফয়েযে ধন্য হলেন অধ্যাত্মিক রাহবার হযরত মাওলানা শাহ সুলতান আহমদ নানুপুরী রহ. (মৃত্যু ১৪১৮ হি.)। বাতি থেকে বাতির আলো গ্রহণের ধারাবাহিকতায় এই মহা মনীষীর ফয়েযপ্রাপ্ত ও স্থলাভিষিক্ত হন আমাদের শাইখ হযরত মাওলানা শাহ্ জমীর উদ্দীন নানুপুরী রহ. (মৃত্যু ১৪৩২ হি.) ।

 তিনি ছিলেন এক নীরব সাধক । মহান পূর্ববর্তীর কাছ থেকে প্রাপ্ত মহান দায়িত্বের প্রতি যত্নবান । স্বীয় উত্তপ্ত হৃদয় দ্বারা বহু হৃদয় উত্তপ্ত করেছেন। অসংখ্য মানুষের আত্মাকে ঈমান ও মারিফাতের আলোয় আলোকিত করেছেন। যিকরে খোদাওয়ান্দীতে জিহ্বাকে তরুতাজা রাখার তালকীন দিয়েছেন । আমলের তরীকা শিখিয়েছেন । ফানা ফীল্লাহ ও ফীনা ফির রসূল বুঝিয়েছেন । এতদুভয়ের জন্য ফানা ফিশ শাইখের স্তর বর্ণনা করেছেন । হযরত বলতেন মেহদী পাতা যতক্ষণ পর্যন্ত নিজেকে না মিটায় ততক্ষণ পর্যন্ত হাতে রং হয় না। তদ্রুপ নিজেকে কানাইয়্যাতের স্তরে উন্নীত করা ছাড়া আল্লাহ প্রেমের স্বাদ অনুধাবন করা যায় না। 

হযরত রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এর পরশে বহু মানুষের জীবন ধারায় এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। পাল্টে যেত হৃদয়ের দিকপাল। কোমল মিষ্টিভাষা বুলেটের মত প্রভাব রাখতো। পথভোলা মানুষ পেত পথের সন্ধান । আল্লাহর দরবারে হযরতের কান্নাকাটি রোনাযারীর মনোমুগ্ধকর পরিবেশ গাফেল হৃদয়কেও জাগ্রত করে তুলতো। আখেরাতের মুহাব্বত পয়দা করতো। পাপী তাপীর হৃদয়ও কেঁদে উঠত, তাওবার আগ্রহ সৃষ্টি হতো। হযরত শাইখ (রহ.) ছিলেন এ দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের আধ্যাত্মিক রাহবার। হাজার হাজার ওলামা-মাশায়েখের পীর ও মুর্শিদ ।

চরিত্র মাধুর্যতাঃ

হযরত শাইখ (রহ.) ছিলেন যাহেরী বাতেনী বহুবিধ গুণাবলীর অধিকারী অত্যন্ত উঁচু মাপের আলিম বিনয়ী ভদ্র ও অতিথি পরায়ণ। সুন্নতে রাসূলের উত্তম নমুনা। তিনি সময়কে সর্বদা কাজে লাগিয়েছেন অযথা গল্প-গুজব থেকে বিরত থেকেছেন। সহিষ্ণুতা ও ধৈর্য ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম ভূষণ । তিনি সহানুভূতি ও মানবতার এক অনন্য ইতিহাস গড়ে গেছেন । হযরত নিজেও বিনয়ী ছিলেন অন্যদেরকেও বিনয়ী হওয়ার উপদেশ দিতেন। হযরত (রহ.) খুব বেশী বলতেন “আমি খারাপ” একথাটা মনকে বুঝাতে হবে । 

নিজেকে খারাপ মনে করতে পারা দিলের রোগের মহৌষধ । হযরত মাওলানা শাহ জমীর উদ্দীন নানুপুরী (রহ.) ছিলেন আকাবির ও আসলাফের উত্তম নমুনা । নিজ শাইখের প্রতি ছিল অগাধ ভক্তি ভালবাসা। ২০০২ সনের কথা অধম দারুল উলূম দেওবন্দে থেকে আসার পর হযরতের সাথে দেখা করি । হযরত খুব আবেগ নিয়ে দারুল উলূমের অবস্থা জানতে চান। বিভিন্ন বিষয় জিজ্ঞাসা করেন। এক পর্যায়ে দারুল উলূম দেওবন্দের পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে বলতে গিয়ে আমি বললাম, হযরত দেওবন্দে সকাল-বিকাল ঝাড়ুদার আছে কখনো ময়লা পড়ে থাকতে দেখা যায় না। 

পরিচ্ছন্নতার খুব এহতেমাম করা হয় । বাগান পরিচর্যার মালি আছে । প্রায় ষাট-পয়ষট্টি জন কর্মচারী । হযরত বিভিন্ন কথা শুনে বললেন, আমাদের আকাবির আসলাফ গাছ লাগিয়েছেন আমরা ফল ভোগ করতেছি । দেখ আমার নানুপুরী হুজুর (রহ.) কেঁদেছেন আর আমরা তার ফল ভোগ করতেছি । যেমন আমের আঁটি নিজেকে মাটিতে বিলিন করার পর আজকে আমগাছের সুস্বাদু পাকা আম আমরা উপভোগ করছি।

 তেমনি আমাদের মুরুব্বীগণ নিজেদেরকে মিটিয়েছেন। কুরবানী পেশ করেছেন । দ্বীনের গাছ লাগিয়েছেন আর আমরা তাদের কুরবানীর সুফল ভোগ করছি গাড়ি দিয়ে দ্বীনী দাওয়াতে যাচ্ছি। মানুষ কত আদর যত্ন করছে । এগুলো সব মুরুব্বীদের অবদান । হযরতের মুখে আকাবির- আসলাফের এ মূল্যায়ন আমাকে খুবই মুগ্ধ করেছে ।

হযরত মাওলানা শাহ্ জমীর উদ্দীন নানুপুরী (রহ.) ছিলেন বহুগুণে গুণান্বিত এক আলোকিত ব্যক্তিত্ব ও প্রশংসিত মহাপুরুষ তিনি ছিলেন সাধারণের মাঝে অসাধারণত্বের ঐশ্বর্যে মহীয়ান । জ্ঞান গভীরতা, হিকমত, তাকওয়া, সাধনা আত্মশুদ্ধি, মানবসেবা, অন্তর্দৃষ্টি, যাযব-আকর্ষণ ছিল তাঁর অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট ।

আতিথেয়তা 

আল্লাহ তা'য়ালার ফযলে এ অধমের বহুবার হযরতের কাছে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। আব্বাজানের নেসবতে তো খুব কাছে যাওয়ারও সৌভাগ্য হয়েছে । মেহমান নেওয়াজীর যেই ফিকির হযরত করতেন তা না বলতেন অন্যথায় নাস্তা আনতে বলতেন । অন্তত চা, তুন্দুল বা বিস্কুট ইত্যাদি না খেয়ে হযরতের সামনে থেকে আসা মুশকিল ছিল । মেহমানদারীতে খুব আড়ম্বনা ছিল না । ছিল উপচেপড়া মুহাব্বত । উষ্ণ নিমন্ত্রণ। আদর সোহাগ স্নেহমাখা সম্বোধন। দীর্ঘ সফরের ক্লান্তি যেন নিমিষেই শেষ হয়ে যেতো। আব্বাজানের সাথে এক সফরে নানুপুর পৌঁছতে রাত প্রায় ১২টা বেজে গেলো । হযরত খাবারের এন্তেজামের জন্য বললেন । 

অতঃপর রাত পৌনে দুইটার দিকে খবর নেওয়ার জন্য হযরত (রহ.) নিজে মেহমানখানায় আসলেন । ঘুমের এন্তেজাম হয়েছে কি না? কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা আব্বাজানের নিকট জানতে চাইলেন । আমি শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম । কতো সচেতন বুযুর্গ । কতটা মহৎ ও উদারতা থাকলে রাত পৌনে দুইটায় সত্তরের কাছাকাছি বয়সের এক শাইখ সারাদিন মাদরাসার এন্তেজাম, নিজের আমল ও অযীফার ব্যস্ততার পর আবার মেহমানের খবর নিতে পারেন । 

এতদিন পর আজ সে আবেগময় দৃশ্য আমার দুচোখ ভিজিয়ে তুলছে । আবেগময় সে স্মৃতি কলমের কালিতে আঁকা কঠিন । আরো আশ্চর্যের বিষয় যা আমাদের শিক্ষণীয় উপাত্ত । এসবকিছুর পর শেষ রাতে উঠে আবার আল্লাহর বান্দা আল্লাহর দরবারে কাঁদছেন এ ধরণের খোদাপ্রেমিকদের শানেই কালামুল্লাহ শরীফে আল্লাহ তা'য়ালা জানিয়ে দিয়েছেন : অর্থ: তারা রাতের কমসময়ই ঘুমাইতো এবং রাতের শেষভাগে ইস্তেগফার করতো (সূরা যারিয়াহ ১৭-১৮)

আয় আল্লাহ! আমাদের তুমি তাওফীক দাও, তোমার প্রিয় বান্দাদের মতো তোমাকে ভালোবাসার । এ বিষয়েও হযরত মুনাজাতে খুব বেশী বলতেন আর কাঁদতেন :

شراب محبت پلا دے خدایا + محبت کی آتش جلا دے خدایا * بتا ہمکو تیرے راہ کس طرف ہے + تیرے راہ پر چلا ہمکوخدایا

অর্থ : আয় আল্লাহ আমাকে তোমার মুহাব্বতের অমীয় সুধা পান করাও । আর তোমার প্রেমের জ্বলনীয় হৃদয়ে জ্বালাও । মেহেরবাণী করে আমাদের বলে দাও না কোন পথে তোমায় পাব, প্রভু হে! আমাদেরকে সে পথের পথিক বানাও ।

কয়েকটি বিষয় খুব সংক্ষেপে তুলে ধরলাম হযরতের সান্নিধ্যে যারা বেশী ধন্য হয়েছেন তারা অনেক বেশী বলতে পারবেন । দয়াময় প্রভু তোমার কাছে শুধু আরযি ও মিনতি জানাচ্ছি-

احب الصالحين و لست منهم = لعل الله يرزقنى صلحا

অর্থ : আয় আল্লাাহ আমি নিজে তো নেক নই তবে তোমার নেক বান্দাদের মুহাব্বতকারীদের একজন । নেককার বান্দাদের মুহাব্বত করি এই আশায় যে, তুমি আমাকেও একটু নেক হওয়ার তৌফিক দিবা ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত দাউদ (আ.) এর পঠিত এ বিষয়ে একটি দুআ

الهم انى اسئلك حبك و حب من يحبك والعمل الذى يبلغنى حبك الهم اجعل حبك احب الي  من نفسى واهلى ومن الماء البارد (ترمذى (۳۴۹۰)

হযরত আবু দারদা (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, নবী দাউদ (আ.) আল্লাাহর নিকট এইভাবে দোআ করতেন- আয় আল্লাহ! আমি তোমার নিকট তোমার মুহাব্বত চাই এবং তোমাকে যারা মুহাব্বত করেছেন তাদের মুহাব্বত চাই এবং ঐ সকল আমলের মুহাব্বত কামনা করছি যা আমাকে তোমার প্রিয়ভাজন হওয়ার উপযুক্ত করে দিবে । 

প্রভু হে তোমার ভালবাসা ও মুহাব্বত আমার হৃদয়ে সবকিছুর চেয়ে প্রবল করে দাও । এমনকি নিজের জান, পরিবার-পরিজন, হৃদয় জুড়ানো ঠাণ্ডা পানির চেয়েও অধিক আল্লাহ তুমি আমাদের সকলকে কবুল করে নাও । আমীন!

লেখক পরিচিতি : হযরত নানুপুরী রহ. এর স্নেহে ধন্য ও মারকাযের নায়েবে মুহতামিম

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন