তাকলীদের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

প্রিয় পাঠক! আজ থেকে প্রায় ১৩০০ বছর পূর্ব থেকে চলে আসা শরই বিধান মাযহাবের অনুসরণ নিয়ে আজ আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব। কেন মাজহাব অনুসরণ করতে হবে? মাজহাব না মানলে কি সমস্যা? মাযহাব মানা এটা কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ? এবং এর প্রয়োজনীয়তা কি? সম্পূর্ণ বিষয়টা নিয়ে আজকে আলোচনা করব।

আশা করি আমাদের সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়লে আপনার মনে মাজহাব ও তাকলীদ নিয়ে আর কোন ধরনের কোন সন্দেহ কিংবা খটকা থাকবে না। ইনশাআল্লাহ।

তাকলীদের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

তাকলীদের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

মাযহাব কী  

দ্বীনের সারকথা হল, শুধু আল্লাহ তা'য়ালার অনুগত হওয়া । এমনকি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর অনুসরণও এ জন্যেই ফরয যে, তিনি তাঁর সকল কাজ কর্মের মাধ্যমে আল্লাহ প্রদত্ত বিধানাবলীকেই তুলে ধরেছেন । তাই শরীয়তের সকল আহকামের ক্ষেত্রে আল্লাহ এবং রাসূলেরই অনুসরণ করতে হবে । আর কেউ যদি অন্য কোন সত্ত্বাকে এ পর্যায়ের অনুসরণযোগ্য মনে করে । তাহলে সে অবশ্যই ইসলামের গন্ডি থেকে বেরিয়ে যাবে ।

কুরআন এবং সুন্নাহর অনুসরণের ক্ষেত্রে যে ব্যাপারটি খুবই স্পষ্ট; তা হলো কুরআন সুন্নাহর কিছু আহকাম এমন আছে যা সাধারণ শিক্ষিত ব্যক্তিও বুঝে নিতে পারে, এর মাঝে কোন অস্পষ্টতা বা বৈপরীত্য পরিলক্ষিত হয় না । কোন ধরনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয় না । যেমন কুরআনে কারীমে রয়েছে-

ان الذين أمنوا وعملوا الصالحات كانت لهم جنت الفردوس نزلا خالدين فيها لا يبغون عنها حولا

অর্থ: যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম সম্পাদন করে, তাদের অভ্যর্থনার জন্য আছে জান্নাতুল ফেরদাউস, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে, সেখান থেকে স্থান পরিবর্তন করতে চাইবে না । (সূরা: কাহাফ, ১০৭)

সাধারণ আরবী জানে এমন যে কোন লোক আয়াতটির অর্থ সহজেই বুঝতে পারবে । এর মধ্যে কোন অস্পষ্টতা নেই, তাই এর মর্মার্থ উপলব্ধি করতেও কোন বেগ পেতে হয় না । তেমনিভাবে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইরশাদ:

لا فضل لعربي على عجمى ولا لعجمي على عربي ولا لاحمر على اسود ولا اسود على احمر الا بالتقوى

অর্থ: অনারবের উপর আরবের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই এবং আরবের উপরও অনারবের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই । কৃষ্ণাঙ্গের উপর শ্বেতাঙ্গের কোন প্রাধান্য নেই এবং শ্বেতাঙ্গের উপরও কৃষ্ণাঙ্গের কোন বিশেষত্ব নেই, শুধু মাত্র তাকওয়া এবং পরহেযগারী ব্যতীত । (-মুসনাদে আহমাদ ৫/৪১১)

এ হাদীসটি বুঝতেও বিশাল জ্ঞানভান্ডারের প্রয়োজন হয় না, সাধারণ আরবী জানলেই এর অর্থ বুঝা যায় ।

কিন্তু এরই বিপরীত কুরআন হাদীসের বহু আহকাম এমন আছে, যার মর্মার্থ অনেক গভীর থেকে উদ্ধার করতে হয় । আবার কিছু আছে যা বাহ্যিক দৃষ্টিতে অন্য একটি আয়াত বা হাদীসের বিপরীত মনে হয় । যেমন ধরুন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন: والمطلقات يتربصن بانفسهن ثلاثه قروؤ

অর্থ: তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীগণ তিন ‘কুরু' প্রতীক্ষায় থাকবে । (সূরা: বাকারা, ২২৮)

এখানে ঋতুবতী মহিলা কতদিন অপেক্ষা করবে সে ব্যাপারে বলা হয়েছে । আর সে ক্ষেত্রে যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তা হলো (কুরু) । আর এ শব্দটি আরবী ভাষায় পবিত্র অবস্থা (طهر ) এবং ঋতু চলাকালীন সময় (حيض) উভয়টিকে বুঝায় । এখন (, ) শব্দটি দ্বারা পবিত্রতার সময় উদ্দেশ্য হলে এর এক অর্থ দাঁড়ায়, আর ঋতু চলাকালীন সময় উদ্দেশ্য হলে অন্য অর্থ দাঁড়ায় এবং সে কারণে মাসআলাও ভিন্ন হয়ে যায় । তাহলে এ ক্ষেত্রে কোন অর্থটি নেয়া হবে? আরেকটি উদাহরণ, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন : من كان له امام فقراءته له قراءه অর্থ: যে ইমামের পেছনে নামায পড়ে তার ইমামের কিরাতই তার কেরাত । (মুসনাদে আহমাদ, ১৪১১৬)

এ হাদীস দ্বারা বুঝা যায়, ইমামের পেছনে নামায পড়লে মুকতাদীর কেরাত পড়তে হয় না, বরং ইমামের কেরাতই যথেষ্ট। অথচ আমরা আরেকটি হাদীস পাই যা এর বিপরীত মনে হয় । রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ

لا صلاة لمن لم يقرأ بفاتحة الكتاب 

অর্থ: যে সূরায়ে ফাতেহা পড়েনি, যেন তার নামাযই হয়নি । (সহীহ বুখারী, ৭১৪)

এ হাদীস দ্বারা বুঝা যায় নামাযে সূরা ফাতেহা পড়া জরুরী । এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, এমন পরস্পরবিরোধী বিষয়ে আমরা কোনটির উপর আমল করবো? মোটকথা, আয়াত এবং হাদীসের ক্ষেত্রে উল্লিখিত সমস্যার ন্যায় আরো অনেক জটিল জটিল সমস্যাও সৃষ্টি হয়, আর এ সমস্ত সমস্যার সমাধান কেবল তারাই দিতে পারবেন যাঁরা একই সাথে কুরআন, হাদীস, ইজমা, কিয়াস তথা সকল উলূমে শরীয়তের উপর পারদর্শী, যা কুরআন হাদীস থেকে মাসআলা বের করার জন্য অত্যাবশ্যক । 

আর এ গুণের একমাত্র অধিকারী যাঁরা ছিলেন তাঁরা হলেন ‘আইম্মায়ে মুজতাহিদীন' যে কথাটি এখানে বিবেচনা করা দরকার তা হলো, ইলমে ওহী চর্চার দুর্যোগপূর্ণ এ যুগে আমরা অনেক তালাশ করেও এমন একজন ব্যক্তি পাই না যিনি সত্যিকার অর্থে উল্লিখিত গুণাবলীর অধিকারী হতে পারেন, এমনকি এর কাছাকাছি পৌঁছারও কল্পনা করা যায় না । 

আর এরই বিপরীত আমাদের পূর্বসূরী আইম্মায়ে মুজতাহিদীন, যাঁরা ছিলেন নববী যুগের একদম কাছাকাছি, যারা কুরআন হাদীসের আহকামের আসল ক্ষেত্র যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারতেন, তা সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারতেন এবং তার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অবগত ছিলেন । তাই আয়াত এবং হাদীস থেকে মাসআলা বের করা ছিলো তাদের জন্য অনেক সহজ । 

তা ছাড়া মেধা, স্মরণশক্তি এবং আমানতদারিতায় তাঁরা ছিলেন অনন্য । তাই যুগে যুগে উলামায়ে কেরাম নিজেদের মেধা এবং জ্ঞানের উপর ভরসা না করে, পূর্ববর্তী ইমামগণ থেকে এমন একজনকে মুকতাদা বা দিশারী হিসেবে নির্বাচন করে নেন । যিনি আহকামে শরইয়্যার প্রতিটি সূক্ষ্ম দিকের উপর গবেষণা করে কুরআন, হাদীস, ইজমায়ে সাহাবা, সুন্নাতে খুলাফা এবং কিয়াসে শরয়ীর আলোকে তার হুকুম বাতলে দিয়ে গেছেন । আইম্মায়ে কেরামের রেখে যাওয়া কুরআন হাদীসের সে বাস্তব রূপরেখাকেই ওরফে-পরিভাষায় (ফিকহী) মাযহাব বলা হয় ।

কোন কোন ক্ষেত্রে মাযহাবের অনুসরণ করা আবশ্যক

এ মাযহাব কেবল তিনটি ক্ষেত্রে হয়েছে, যে তিনটি ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান মানার সরাসরি কোন পথ কুরআন-হাদীসে নেই । 

  1. যে বিষয়ে কুরআন-হাদীসে কোন সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় না । 
  2. পাওয়া যায় কিন্তু অস্পষ্ট । 
  3. সুস্পষ্টই কিন্তু পরস্পর বিরোধী । 

এই তিন ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান পালন করার সরাসরি কোন পথ কুরআন-হাদীসে নেই । তাই মুজতাহিদগণ সেই বিষয়ে সমাধান বের করেছেন । মাযহাবের ইমামগণ শরীয়ত প্রণেতা নন : তবে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, এ সকল আইম্মায়ে কেরাম তথা মাযহাবের ইমামগণ হলেন কেবল শরীয়তের ব্যাখ্যাকারী, তারা শরীয়ত প্রণেতা নন । 

তাই আমরা আইম্মায়ে কেরামের ব্যাখ্যা অনুযায়ী আল্লাহর শরীয়তকে মানি, তাদেরকে স্বয়ং শরীয়ত প্রণেতা মনে করি না । এভাবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীতে একাধিক আয়িম্মায়ে মুজতাহিদ ছিলেন; যারা শরীয়তের বিভিন্ন বিষয়ে ইজতিহাদ করে মানুষের জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহকে মানার জন্য একটি স্বতন্ত্র ব্যবস্থা কায়েম করেছেন । 

মাযহাব একাধিক হলো কেন

এখন প্রশ্ন দাঁড়ায় মাযহাব একাধিক হল কেন? শুধু একটি হতে পারত না? আসলে আইম্মায়ে মুজতাহিদদের মত পার্থেক্যের কারণ সম্পর্কে অবগত হলে এ প্রশ্ন আর থাকবে না ।

দ্বীনী বিষয়ে মতপার্থক্য সাহাবা কেরামের যুগ থেকে চলে আসছে : কিছু লোক এমন আছেন যারা শাখাগত বিভিন্ন বিষয়ে মহান সাহাবীগণের যুগ থেকে চলে আসা শরীয়ত স্বীকৃত মত পার্থক্যের ব্যাপারে সমালোচনা করে থাকেন এবং বলেন : কুরআন এক, হাদীস এক, রাসূল এক তার পরও এত মাযহাব ও মতপার্থক্য কেন হবে? অথচ তাদের এ কথাটি কুরআন-হাদীসের নীতি, সাহাবায়ে কেরামের আমল ও সাধারণ বিবেক বহির্ভূত বিষয় । কারণ আমরা দেখতে পাই স্বয়ং রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপস্থিতিতেও সাহাবাদের মাঝে মত পার্থক্য হয়েছে এবং তাতে কোনো দলকেই তিরস্কার করা হয়নি ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খন্দকের যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে ঐশী নির্দেশে হযরত বিলাল রা. কে ঘোষণা দিতে বললেন - من كان سامعا مطيعا فلا فلا يصلين العصر الا في بني قريظه

অর্থ, যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাধ্য ও অনুগত সে যেন বনু কুরাইযা মহল্লায় গিয়েই আছরের নামায পড়ে ।

ঘোষণা শোনামাত্রই সবাই অস্ত্র হাতে রওনা হলেন । অনেকেই সময়মতো পৌঁছে গেলেন । কিছু সাহাবী রাস্তায় ছিলেন । এদিকে আছরের সময় শেষ হয়ে যাচ্ছিল । তাঁদের মধ্যে মতভেদ হল, নামায কোথায় পড়া হবে। কিছু সাহাবী বললেন, আমরা সেখানেই নামায পড়ব যেখানে পড়তে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশ করেছেন । 

অন্যরা বললেন, তাঁর উদ্দেশ্য এই ছিল না যে, আমরা নামায কাযা করি । শেষে কিছু সাহাবী পথিমধ্যেই নামায পড়ে রওনা হলেন । অন্যরা বনু কুরাইযায় পৌঁছে নামায পড়লেন । তখন সূর্য ডুবে গেছে । তাঁদের বক্তব্য ছিল, আমরা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশ পালন করেছি ।

অতএব আমাদের কোনো অপরাধ নেই । পরিশেষে এই ঘটনা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে উপস্থাপিত হল । তিনি কাউকেই ভৎসনা করলেন না । (-সহীহ বুখারী, কিতাবুল মাগাযী, হাদীস ৪১১৯, সহীহ মুসলিম, কিতাবুল জিহাদ, হাদীস ১৭৭০, সীরাতে ইবনে হিশাম ৬/২৮২, আলমু'জামুল কাবীর, তবারানী ১৯/৮০)। এই মতভেদ যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশের অর্থ নির্ধারণ নিয়ে হয়েছিল এবং প্রত্যেকেরই উদ্দেশ্য ছিল নবীজীর আনুগত্য ও আদেশ পালন তাই কোনো দলকেই তিরস্কার করা হয়নি । 

তেমনি সহীহ বুখারীর একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, হযরত উমর রা. ও হযরত হিশাম ইবনে হাকীম রা. এর মধ্যকার কুরআনের কিরাত নিয়ে বিরোধ হয়েছে যা সাময়িক ঝগড়ার রূপ ধারণ করেছিল । হযরত উমর রা. হযরত হিশাম রা. কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট হাজির করে তার বিরুদ্ধে নালিশ করেছিলেন। নবীজী প্রত্যেকের পড়া শুনলেন । এরপর প্রত্যেককেই বললেন-

هكذا انزلت

অর্থাৎ- এভাবে কুরআন নাযিল হয়েছে । (-সহীহ বুখারী ৮/৬৩৯-৬৪০ (ফাতহুল বারী) ।

এভাবে তাবেঈ, তাবে তাবেঈদের যুগেও অনেক বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দেয় এবং তারা তাদের ইজতেহাদের ভিত্তিতে সেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন এবং সিদ্ধান্ত দিতে গিয়ে তাদের মাঝে মতবিরোধও হয়েছে। হাদীস ও আসারের বিভিন্ন কিতাবে তা বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে ।

তাই দ্বীনের ফুরূয়ি (শাখাগত) বিষয়ে মতভিন্নতা অনিবার্য । এক্ষেত্রে সকলের মত বা মাযহাব এক ও অভিন্ন হওয়া অসম্ভব । এর অনেক কারণ রয়েছে । তন্মধ্যে তিনটি মৌলিক কারণ হচ্ছে এই-

আইম্মায়ে মুজতাহিদদের মাঝে মত পার্থক্যের বিশেষ কারণ 

১. সুন্নাহর বিভিন্নতার ক্ষেত্রে মতভেদ 

অর্থাৎ, কোনো ইবাদতের পদ্ধতি সম্পর্কিত এমন কিছু পার্থক্য, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগেও ছিল এবং খুলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবায়ে কেরামের যুগেও ছিল । কারণ এসব ক্ষেত্রে একাধিক সুন্নাহ বা পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে । আর সাহাবায়ে কেরামের মাঝেও উভয় পদ্ধতি অনুযায়ী আমল হয়েছে।

২. দলিলের মর্মোদ্ধার, গ্রহণযোগ্যতা বিচার ও দলিলসমূহের পরস্পর বিরোধের ক্ষেত্রে মতভেদ 

অর্থাৎ, কোনো বিষয়ের বিধান কোনো আয়াত বা হাদীস থেকে গ্রহণ করা যায়, তবে ওই আয়াত বা হাদীসটি ওই সিদ্ধান্তের জন্য স্পষ্ট দলিল নয় । অর্থাৎ, এ আয়াত বা হাদীসে একাধিক অর্থের বাস্তব সম্ভাবনা রয়েছে। এ কারণে মুজতাহিদ ইমাম কিংবা ফকীহগণের মাঝে মতভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে । 

আবার এমনও হয় যে, মাসআলার বিধান সম্পর্কে কোনো হাদীস আছে, কিন্তু ইলমুল ইসনাদ বা উসূলে হাদীসের নীতিমালা অনুযায়ী তা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত কিনা, পারিভাষিক শব্দে বললে, ওই হাদীসটি সহীহ বা দলিলযোগ্য কিনা- এ বিষয়ে হাদীসবিশারদ মুহাদ্দিসগণের মাঝে মতভিন্নতা আছে । ইত্যাদি কারণে মতভিন্নতা হয়েছে ।

৩. রায় ও কিয়াসের বিভিন্নতাজনিত মতভেদ 

ওই নতুন সমস্যা, যা নবী-যুগ ও খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগের পর সৃষ্টি হয়েছে, যার সমাধান না কোনো আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে, না কোনো হাদীসে, আর না এ বিষয়ে পূর্ববর্তী ফকীহগণের ইজমা আছে । এ-ধরণের বিষয়ে মুজতাহিদ ইমামগণকে রায় ও শরয়ী কিয়াসের সাহায্যে ইজতিহাদ করতে হয়েছে। আর ইজতিহাদের ক্ষেত্রে মতপার্থক্য হওয়া খুবই স্বাভাবিক । 

ইত্যাদি কারণেই ফুকাহায়ে কেরামের মাঝে মত পার্থক্য হয়েছে । এবং তা হওয়া অবশ্যম্ভাবী । তা অস্বীকার করার কোন সুযোগ কারো নেই । সুতরাং বুঝা গেল উম্মতের ফুকাহায়ে কেরাম যে ইখতিলাফ বা মতবিরোধ করেছেন তা তাদের মনগড়া করেননি । বরং কোরআন ও সুন্নাহর উপর সঠিকভাবে আমল করতে গিয়েই এই মত পার্থক্য হয়েছে ।

মাযহাব চারটি কেন ?

এ ইজতিহাদ প্রথম শতাব্দী থেকে চলে আসছে । হিজরী প্রথম শতাব্দী থেকে ৪র্থ শতাব্দী পর্যন্ত দুনিয়াতে অনেক অনেক মুজতাহিদ ছিলেন । তাই অনেক মাযহাব হওয়ার কথা ছিল । তাহলে মাযহাব মাত্র চারটি হলো কেন? এর উত্তর হলো, অন্যান্য মুজতাহিদরা বিভিন্ন বিষয়ে ইজতিহাদ করে সমাধান বের করেছেন কিন্তু মানব জীবনের সকল ব্যাপারে সব সমস্যার সমাধান শুধু মাত্র চার মাযহাবের চার ইমাম ছাড়া আর কেউ বের করতে সক্ষম হননি । 

সর্ব যুগের সব লোকের সব সমস্যার সমাধান বিস্তারিতভাবে বের করা হয়েছে এবং সুবিন্যস্ত করা হয়েছে মাত্র চার মাযহাবে । আর বাকী মুজতাহিদগণ বিশেষ বিশেষ বিষয়ে ইজতিহাদ করেছেন । এ কারণে অন্যান্য মুজতাহিদগণের মাযহাব প্রচলিত হয়নি।

সাথে সাথে অন্যান্য সব মাযহাব সুবিন্যস্ত গ্রন্থাকারে সংরক্ষিতও হয়নি । তাই ধীরে ধীরে সেগুলো বিলুপ্তির শিকার হয়। পক্ষান্তরে এই চার মাযহাব প্রতিভাবান, বিশেষজ্ঞ আলিমগণের মাধ্যমে সুবিন্যস্ত গ্রন্থবদ্ধ আকারে সংরক্ষিত হয় এবং সর্বত্র সহজলভ্য হয় । তদ্রূপ সর্বযুগে সবদেশে চার মাযহাবের অসংখ্য বিশেষজ্ঞ আলিম বিদ্যমান আছেন। 

ফলে জনসাধারণ থেকে শুরু করে মুহাদ্দিস মুফাসির এমনকি পরবর্তী মুজতাহিদ পর্যন্ত এ চার মাযহাবের কোন একটি অনুসরণ করতে থাকেন । এভাবে মাযহাব চারটির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়েছে এবং চার ইমামের নামে চারটি মাযহাব প্রচলিত হয়েছে । 

উক্ত চার জন ইমাম হলেন, 

  1. হযরত ইমাম আবূ হানিফা (রহ.) (জন্ম ৮০ হিজরী, মৃত্যু ১৫০ হিজরী), 
  2. হযরত ইমাম শাফিয়ী (রহ.) (জন্ম ১৫০ হিজরী, মৃত্যু ২০৪ হিজরী), 
  3. হযরত ইমাম মালেক (রহ.) (জন্ম ৯৪ হিজরী, মৃত্যু ১৭৯ হিজরী), 
  4. ও হযরত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) (জন্ম ১৬৪ হিজরী, মৃত্যু ২৪১ হিজরী) । 

পরবর্তীতে তাদের মাধ্যমে ও তাদের শাগরিদদের মাধ্যমে কিতাব আকারে লিপিবদ্ধ হয়ে সংরক্ষিত হয়ে আছে । অতপর তৎকালীন উলামায়েকেরাম সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, কোন ব্যক্তি দ্বীন মানতে হলে ঐ চার ইমামের কোন একজনকে মেনে দ্বীন মানবে । মনগড়া দ্বীন মানলে তা সঠিক আল্লাহর শরীয়ত মানা হবে না । বরং নিজের কুপ্রবৃত্তির পূজা করা হবে যা পরিষ্কারভাবে কুরআনে কারীমে নিষেধ করা হয়েছে । 

আর ‘ইজমা' শরীয়তের একটি অকাট্য দলীল । মাযহাব মানা ইজমা দ্বারা ওয়াজিব হয়েছে । তাই শরীয়তের অন্যান্য বিষয় যেমন দলীল দ্বারা প্রমাণিত হওয়ার কারণে সবাই তা মেনে চলেছে তদ্রুপ মাযহাবও শরীয়তের দলীল দ্বারা প্রমাণিত হওয়ার কারণে মুজতাহিদ নয় এমন সকলের জন্য মাযহাবের অনুসরণে আল্লাহর শরীয়ত মানা জরুরী । দুটি উদাহরণের প্রতি লক্ষ করলে বিষয়টি আরো সুন্দর করে বুঝে আসবে । কুরআনে কারীমে কুরআন তিলাওয়াত করার আদেশ করা হয়েছে । কিন্তু বর্তমানে সারাবিশ্বে যে দশ কারীর 'কিরাত' প্রচলিত আছে, তাদের নাম কুরআনে উল্লেখ করা হয়নি । 

আর এ হুকুমও নেই যে, দশ কারীর যে কোন এক কারীর কেরাত অনুসারে কুরআন পড়া জরুরী । অথচ ভারত উপমহাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশের সকল মুসলমান কারী আসেম কুফী রহ. এর কিরাত, কারী হাফস কুফী রহ. এর রেওয়ায়েত অনুসারেই কুরআন পড়ে আসছে এবং তা ইজমা তথা উম্মতের ঐক্যমতের মাধ্যমে প্রমাণিত ।

তেমনিভাবে কুরআন হাদীস দ্বারা একথা প্রমাণিত আছে যে, হাদীসের অনুসরণ করা জরুরী, কিন্তু সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, সুনানে আবূ দাউদ, সুনানে তিরমিযী, সুনানে নাসায়ী, সুনানে ইবনে মাজাহ- এ কিতাবগুলোকে কুরআন হাদীসের কোথাও ‘সিহাহে সিত্তা' বলা হয়নি । তেমনিভাবে সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিমকেও কোথাও ‘সহীহাঈন' বলা হয়নি ।

যেমনিভাবে দশ কারীর 'কারী' হওয়া ইজমায়ে উম্মত দ্বারা প্রমাণিত, যেমনিভাবে প্রসিদ্ধ ছয় কিতাবের সংকলকগণের মুহাদ্দিস হওয়া প্রমাণিত, ঠিক তেমনিভাবে চার ইমামের মুজতাহিদ হওয়াও ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। আর গায়রে মুজতাহিদের জন্যে মুজতাহিদের ‘তাকলীদ' করা, কুরআন এবং হাদীস দ্বারা প্রমাণিত ।

মাযহাব-বিরোধীতা কখন থেকে এবং তাদের কাছে কিছু আরজ 

মুসলিম উম্মাহর এই সর্বসম্মত কর্মধারার বিরুদ্ধে সর্ব প্রথম দলবদ্ধ আওয়াজ ওঠে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগের সাড়ে বারশো বছর পরে । আর তা-ও এই উপমহাদেশে এবং ইংরেজদের শাসনামলে, যাদের রাজ্য- শাসনের পলিসিই ছিল devide and rule “বিভেদ সৃষ্টি কর এবং রাজ্য-শাসন কর” ।

এই বিরোধী আওয়াজটির বাস্তবতা বড়ই অস্পষ্ট অথবা সীমাহীন স্ববিরোধিতার এক সমষ্টি । আমরা আমাদের দেশের গাইরে মুকাল্লিদ ভাইদের (যারা নিজেদেরকে আহলে হাদীস নামে পরিচয় দেন) অনেক পুস্তিকা ও লিফলেট পড়েছি, তাদের নেতৃবৃন্দের বক্তব্য শুনেছি, কারো কারো সাথে আমাদের আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু এসব কিছুর পরেও তাদের বিভ্রান্তি বা অসাধুতাই আমাদের সামনে পরিস্ফুট হয়েছে ।

এরা তাকলীদ করা বা মাযহাব মানাকে না-জায়েয, হারাম, এমনকি শিরক পর্যন্ত বলে থাকে । তাদের কেউ কেউ বলে, সাধারণ মানুষের জন্য তাকলীদ জায়েয, আলেমদের জন্য না-জায়েয । কেউ বলে, তাকলীদ জায়েয তবে নির্দিষ্ট কোন আলিমের তাকলীদ না-জায়েয । আবার কেউ 'মাযহাব মানা ফরয নয়' এটুকু বলে চুপ করে থাকে। ফরয না হলে কি? এ কথাটা আর বলে না ।

এখানে আমরা এইসব ভ্রান্ত কথাগুলোর বিস্তারিত পর্যালোচনা করতে চাই না, বা তার প্রয়োজনও নেই । কেননা এ বিষয়ে দলীল-প্রমাণ সমৃদ্ধ, যথোপযুক্ত আলোচনা বহু গ্রন্থেই রয়েছে । আমরা শুধু এটুকু বলতে চাই যে, তাকলীদ বিরোধী লোকদের বিভিন্ন বই-পুস্তক অধ্যয়ন করে এবং তাদের বেশ কিছু লেকচার শুনে এ বিষয়টিই জানা গেছে যে, তারা-

  1. তাকলীদ বা মাযহাব মানার পরিচয় দেয় “অন্ধ অনুসরণ” দ্বারা ।
  2.  তাদের মতে, কারো দলীল বিহীন কথাকে শর্তহীনভাবে মেনে নেওয়ার নাম তাকলীদ বা মাযহাব মানা । চাই কথাটি কুরআন-হাদীসের অনুকূলে হোক বা কুরআন-হাদীস পরিপন্থী ।
  3. তাদের বক্তব্য হল, মুকাল্লিদগণ তাদের ইমামদেরকে "মাসুম-ভুল-ত্রুটির উর্ধ্বে” মনে করে। অর্থাৎ তারা যেন ইমামগণকে রাসুলের স্থানে পৌঁছে দিচ্ছে।

এ ধরনের আরো কিছু কথা তারা বলে যার সাথে তাকলীদকারী বা মাযহাব অনুসরণকারীদের কোনই সম্পর্ক নেই । আমরা নিজেরাও মুকাল্লিদ, ফিকহে হানাফীর তাকলীদ করি । ঐসব বন্ধুরা তাকলীদের যে অর্থ করেছেন এবং মুকাল্লিদদের অবস্থার যে চিত্র অংকন করেছেন-এর সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই । 

আমরা আম্বিয়া আলাইহিমুস্ সালাম ছাড়া আর কাউকে মাসূম ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে মনে করি না । ইমাম আবু হানীফা রহ. কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একজন উম্মত এবং তাঁর শরীয়তের খাদেম মনে করি । তাঁর ফিকহের অনুসরণ আমরা এজন্যই করি যে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শরীয়তের হুকুম আহকাম জানার জন্য ফকীহগণের শরণাপন্ন হওয়ার আদেশ করেছেন ।

ইমাম আবূ হানিফা রহ.-এর কোন কথা যদি শরীয়তের দলীল দ্বারা ভুল প্রমাণিত হয় তাহলে সেটা হানাফী ফিকহের মধ্যে “ফতোয়া যোগ্য” বিবেচিত হয় না । তাহলে আমরা কীভাবে কুরআন-হাদীসের বিরোধিতা করে তাঁর তাকলীদ করলাম? আমরা তো কুরআন-হাদীসের সত্যিকার অনুসরণের জন্যই, নিজেদের ‘কাঁচা বুঝ’ বা কোন অযোগ্য লোকের “কাঁচা বুঝের” উপর নির্ভর না করে উম্মাহর সর্বজন স্বীকৃত ফকীহ ইমাম আবূ হানিফা রহ.-এর ফিকহের অনুসরণ করছি ।

মোট কথা, মাযহাব এবং ফিকহের হাকীকত সম্পর্কে এই নিবন্ধের শুরুর দিকেই আলোচনা করা হয়েছে । তাকলীদ - বিরোধীগণ যদি এই অর্থেই “তাকলীদ” বা “ফিকহে”র বিরোধিতা করে থাকেন তাহলে বাস্তবিকই মুকাল্লিদদের সাথে তাদের বিরোধিতা হতে পারে । 

কিন্তু তাকলীদ বা মাযহাব মানার এমন অর্থ বয়ান করা, যে অর্থে তাকলীদ ও মাযহাব ভুল প্রমাণিত হয় এরপর অন্যায়ভাবে তা মুকাল্লিদদের মাথায় চাপিয়ে দেওয়া, এসব কাজের কোন বৈধতা হতে পারে কি? না কি তাদের উদ্দেশ্যই হল মুসলিম জাতির মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্য ছড়ানো? আমরা সেই সব বন্ধুদের খেদমতে আরয করতে চাই; আপনারা তাকলীদের সেই পরিচয় নিয়ে একবার ভাবুন যা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে এবং যে নিয়ম অনুযায়ী মুসলিম উম্মাহর বৃহৎ অংশের আমল চলে আসছে । এরপর বলুন এ ধরনের তাকলীদ বা এই অর্থে মাযহাব মানার ব্যাপারে আপনাদের কোন আপত্তি আছে কি না? যদি থাকে তাহলে কেন? এটাই হবে যৌক্তিক ও ন্যায় সংগত পন্থা । 

শুধু শুধু নিজেদের পক্ষ থেকে একটি মতবাদ তৈরী করে তা কারো কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে এরপর মনের সুখে তার খন্ডন কার্যে নিমগ্ন হওয়া তো কোন ন্যায় সংগত পন্থা হতে পারে না । আর না এধরনের কাজে লিপ্ত হওয়া কোন হাদীস-অনুসরণকারী মুসলমানের পক্ষে শোভা পায় । 

বন্ধুবর্গের খেদমতে শুধু একটিই প্রশ্ন, যে সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য আমরা উম্মাহর ফকীহগণের সংকলিত ফিকহের শরণাপন্ন হয়েছি আপনারা যখন সেই ফিকহের প্রয়োজন বোধ করেন না, তো এই সব সমস্যার সমাধান আপনারা কীভাবে করেন? শুধুই নিজের মত ও সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে? না পরবর্তী যুগের কোন আলেমের ‘বুঝে’র উপর নির্ভর করে? না তৃতীয় কোন পথ অবলম্বন করে ? এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবুন এরপর ইনসাফের সাথে বলুন, ফিকহের অনুসারীরাই সরল-সঠিক পথের উপর আছেন? না আপনারা ?

আর একটি বিষয়েও ভাবুন, মুসলিম উম্মাহর অধিকাংশ ব্যক্তি এবং আপনাদের মধ্যে মত পার্থক্যটি হচ্ছে হাদীস- অনুসরণের পন্থা ও পদ্ধতি নিয়ে । আপনারা এ ব্যাপারে একটি নব-আবিষ্কৃত কর্ম-পন্থা অবলম্বন করতে চান । আর মুসলিম উম্মাহর অধিকাংশ মানুষ থাকতে চান সুন্নাহ-নির্দেশিত পন্থার উপরই । 

হাদীস অনুসরণের মূল কথাটিতে তো কারো কোন দ্বিমত নেই । তাহলে এই গোটা মুসলিম জাতির বিপরীতে আপনারা কীভাবে নিজেদেরকে 'আহলে হাদীস' নামে পরিচয় দেন? আর তাদেরকে আখ্যা দেন হাদীস অমান্যকারী রূপে? হাদীস অনুসরণের পন্থা ও পদ্ধতি নিয়ে যে মতবিরোধ আপনারা কোন যুক্তিতে তাকে খোদ ‘হাদীস অনুসরণের' মতবিরোধ সাব্যস্ত করেন ? আল্লাহর ওয়াস্তে একটু ভাবুন, এবং কোন হানাফী মাযহাবের অনুসারীকে তাওবা করিয়ে গাইরে মুকাল্লিদ বানানোর এই না- জায়েয বা অন্তত অর্থহীন কর্মকান্ড পরিত্যাগ করে অমুসলিম ও মুশরিকদেরকে মুসলমান বানানোর চেষ্টা করুন । 

কিন্তু যদি আপনারাও আপনাদের কোন কোন বেইলম অনুসারীর মত হানাফী থেকে গাইরে মুকাল্লিদ হওয়াকে কাফের থেকে মুসলমান হওয়ার সমর্থক মনে করেন তাহলে তো এসব কথা আপনাদেরকে বলাও একটা অর্থহীন পরিশ্রমই হবে । আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হেফাযত করুন এবং ইসলামের এই দুর্দিনে বহুধা বিভক্ত উম্মতকে একত্রিত ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাওফীক দিন । আমীন ।

মাযহাব বিষয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তর :

প্রশ্ন: বিতর্কিত কোন মাসআলা সামনে এলে প্রশ্ন করা হয়, এটা হাদীসে আছে কিনা?

উত্তর: এভাবে প্রশ্ন করা ঠিক নয় । সঠিক প্রশ্ন হতে পারে, এ বিষয়ে শরীয়তের কোন দলিল আছে কি না? কারণ হাদীসই শরীয়তের একমাত্র দলিল নয়, শরীয়তের আরও দলিল আছে ।

প্রশ্ন: কোন বিষয়ে হাদীস দেখানো হলে, বলা হয় এ হাদীসটি সহীহ বুখারীতে আছে কি না?

উত্তর: এ প্রশ্নটিও সঠিক নয় । কারণ শরীয়তের সমস্ত বিধান শুধু সহীহ বুখারীর হাদীস দ্বারা প্রমাণ করা সম্ভব নয় । যদি সম্ভব হত তাহলে ‘কেরাত খলফাল ইমাম' ও 'রাফয়ে ইয়াদাইন' মাসআলা-দু'টি প্রমাণ করার জন্য খোদ ইমাম বুখারী রহ. সহীহ বুখারী লেখার পরও আরও দু'টি কিতাব লিখতে বাধ্য হতেন না।

প্রশ্ন: বলা হয়, সহীহ বুখারীতে কোন হাদীস থাকলে সেটিই প্রাধান্য পাবে ।

উত্তর: এ কথাটিও সঠিক নয়। কারণ একটি হাদীস অপর হাদীসের উপর প্রাধান্য পাওয়ার শতাধিক কারণের মধ্য থেকে সহীহ বুখারীতে থাকা একশরও পরবর্তী কারণ হিসাবে স্থান পেয়েছে। তাই এর পূর্ববর্তীগুলোকে উপেক্ষা করে এটিকেই আঁকড়ে থাকা সুবিবেচনা নয় ।

প্রশ্ন: বলা হয়, কেয়াস শয়তানের কাজ । কেয়াস করা যাবে না ।

উত্তর: এ কথাটি সঠিক নয়। যেসব নবোদ্ভূত বিষয়ে সরাসরি কোন আয়াত বা হাদীস পাওয়া যায় না; সেসব বিষয়ে অনুমোদিত কেয়াস ব্যতীত হালাল-হারামের সমাধান দেওয়া সম্ভব নয় ।

প্রশ্ন: বলা হয়, হাদীস সহীহ হলেই তার উপর আমল করা জরুরী, এর কোন অন্যথা নেই ।

উত্তর: এ কথাটি সঠিক নয় । “সহীহ” একটি পারিভাষিক শব্দ । মুহাদ্দিসগণ এ শব্দটি বহু অর্থে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন । তন্মধ্যে একটি হলো, যখন এটি যঈফের বিপরীত শব্দরূপে ব্যবহার হয় । এরও রয়েছে সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা ও অনেক শর্ত । সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, অনেক আলেমও এর সংজ্ঞা ও শর্তের খবর রাখেন না। অথচ সাধারণ মানুষের মুখে একথা তুলে দেওয়া হয়েছে, সহীহ হাদীস অনুসারে আমল করতে হবে। কিন্তু এই শেষোক্ত কথাটিই যদি মেনে নেই তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায়, সব সহীহ হাদীসই কি আমলযোগ্য? নাকি এর জন্য আরো কোন শর্ত রয়েছে ? হ্যাঁ, শর্ত অবশ্যই রয়েছে । যেমন:

  1. হাদীসের বিধানটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য খাস না হতে হবে।
  2. হাদীসটি মানসুখ বা রহিত না হতে হবে।
  3. হাদীসটি অনুসারে সাহাবা, তাবিঈন ও মুজতাহিদ ইমামগণের আমল থাকতে হবে । আমল না থাকা রহিত হওয়ার
  4. আলামত ।
  5. হাদীসটি ব্যক্তিবিশেষে বা সময়বিশেষের জন্য খাস না হতে হবে ।
  6. এমনিভাবে হাদীসটি কুরআনের আয়াত, হাদীসে মুতাওয়াতির বা অপর কোন সহীহ হাদীসের সাথে বাহ্যিকভাবে বিরোধপূর্ণ না হতে হবে ।

যেমন সহীহ হাদীসে একই সময়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চারের অধিক স্ত্রী থাকার কথা রয়েছে। কিন্তু তা নবীর সাথে খাস, উম্মতের জন্য নয় । (--দলীলসহ নামাযের মাসায়েল ও হাদীসের অনুসারীদের প্রতি)

প্রশ্ন: বলা হয়, আল্লাহ এক, রাসূল এক, এত মত কেন? 

উত্তর: এ কথাটিও সঠিক নয়। খেয়াল করতে হবে 'আল্লাহ এক, রাসূল এক' যে বলেছি এখানেও দু'টি বিষয় হয়ে গেছে । একটি হচ্ছে কুরআন, অপরটি হচ্ছে হাদীস । এখন কুরআনে যদি বলা হয়, যখন কুরআন তেলাওয়াত করা হয় তখন তোমরা তা শোন এবং চুপ থাক; তখন কেউ যদি কোন হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলে, না, কুরআন তেলাওয়াতকালে সূরা ফাতেহা পড়তে হবে, তাহলে এখানেই দু'টি মত হয়ে গেল এবং আয়াত ও হাদীসকে সামনে রেখেই দু'টি মত হয়ে গেল ।

আর যদি ‘এত মত কেন হবে' -এর অর্থ হয়, আমার মতের বাইরে অন্যরা কেন মত পেশ করবে? তাহলে এ মানসিকতার যে চিকিৎসা আছে তা শুনতেও ভাল শোনায় না এবং দেখতেও ভাল দেখায় না ।

প্রশ্নঃ বলা হয়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো আমাদেরকে কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী চলতে বলেছেন । কোন ফকীহ বা মুজতাহিদের দ্বারস্থ হতে বলেন নি ।

উত্তর: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো ঐ হাদীসে আমাদেরকে আরবী ব্যকরণ, বালাগাত, অভিধান, হাদীস শাস্ত্রের মূলনীতি, তাফসীরবিদদের পরিভাষা, রিজাল শাস্ত্র বা হাদীস বর্ণনাকারীদের জীবনীমূলক গ্রন্থসমূহ ইত্যাদি বিষয়ে পড়ালেখার কথাও বলেন নি। এমনকি কোন তাফসীরবিদ ও হাদীসবিদের দ্বারস্থ হতেও বলেননি। 

তাহলে কি এসব ছাড়াই কুরআন-সুন্নাহ বুঝা যাবে এবং তদনুযায়ী আমল করা সম্ভব হবে? যদি বলা হয়, এসবের প্রয়োজনীয়তা বলার অপেক্ষা রাখে না, তাহলে বলব, মুজতাহিদ ইমামগণের প্রয়োজনীয়তা ও মুখাপেক্ষিতাও একইভাবে বলার অপেক্ষা রাখে না ।

প্রশ্নঃ اذا صح الحديث فهو مذهبيঅর্থ, হাদীস যদি সহীহ হয় তবে সেটিই আমার মাযহাব- ইমামগণের এ কথার মর্ম কি ?

উত্তর: একথাটি দিয়ে একটি মহল সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চায় এবং বলে তোমাদের ইমামরাই তো বলেছে সহীহ হাদীস মানতে সুতরাং তোমরা অমুক অমুক বিষয়ের এই এই সহীহ হাদীস রয়েছে তা মান । আসলে তাদের মতলব খারাপ । তারা এর যথাযথ ব্যাখ্যা করে না বা নিজেরা এর মর্ম বুঝে না । এর যথাযথ মর্ম উপলব্ধি করা হলে মানুষকে ধোঁকা দেয়া যাবে না । এর সঠিক মর্ম হল,

ক. হাদীস সহীহ হলেই তার ওপর আমি আমার মত ও মাযহাবের ভিত্তি রাখি । এ হিসাবে যত মাসআলায় তারা সমাধান দিয়েছেন, সহীহ হাদীস অনুসারেই দিয়েছেন । এ মর্ম গ্রহণ করলে মতলববাজদের মতলব পূরণ হয় না । 

খ. যারা ঐ কথাটির এই মর্ম গ্রহণ করেছেন যে, কোন সহীহ হাদীস পাওয়া গেলে সেটাই আমার মাযহাব বলে গণ্য হবে, তারাও এর সঙ্গে এমন শর্ত জুড়ে দিয়েছেন, যার কারণে মতলবওয়ালাদের মতলব সিদ্ধি হয় না । 

শর্তগুলোর বিস্তারিত বিবরণ, ইমাম নববী (মৃত্যু ৬৭৬ হি.) ‘আল মাজমু’তে, হাফেজ আবু আমর ইবনুস সালাহ (মৃত্যু ৬৪৩ হি.) ‘আদাবুল মুফতী ওয়াল মুসতাফতী তে, হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী (মৃত্যু ৮৫২) 'ফাতহুল বারী'তে ও ইবনে আবেদীন শামী রাহ. (মৃত্যু ১২৫২) শরহু উকুদি রাসমিল মুফতী'তে দিয়েছেন, যার সারসংক্ষেপ হল,

  1. হাদীসটি ইমামগণের নিকট পৌঁছে নি- এ মর্মে নিশ্চিত জ্ঞান থাকতে হবে । এর জন্য ইমামগণের ও তাদের শিষ্যগণের রচিত গ্রন্থাবলি পরিপূর্ণ অধ্যয়ন ও অনুসন্ধান করতে হবে ।
  2. যে ব্যক্তি ইমামগণের মত ছেড়ে ঐ সহীহ হাদীস অনুসারে আমল করবেন তাকে মুজতাহিদ পর্যায়ের আলেম হতে হবে ।
  3. যে মাযহাবের ক্ষেত্রে পরিবর্তন করা হবে ঐ মাযহাবের ইমাম ও তার বড় বড় শিষ্যগণের কারো মতের সঙ্গে হাদীসটি মিলতে হবে ।

এসব শর্ত উপেক্ষা করে যে কেউ যদি তার নিজের বিচার-বিবেচনায় কোন সহীহ হাদীসকে কোন ইমামের মাযহাব আখ্যা দিতে যান, তাহলে ইমামগণের প্রতিষ্ঠিত ও পরীক্ষিত মাযহাব মানুষের হাতের খেলনায় পরিণত হবে । একজন একটি সহীহ হাদীস পেয়ে বলবেন, এটাই ইমামগণের মাযহাব ।

 আরেকজন এর বিপরিত আরেকটি সহীহ হাদীস পেয়ে বলবেন, এটাই ইমামগণের মাযহাব । একজন একটি হাদীসকে সহীহ মনে করে ইমামগণের মাযহাব আখ্যা দেবেন । অন্যজনের দৃষ্টিতে হাদীসটি সহীহ না হওয়ায় তিনি বলবেন, না, এটা ইমামগণের মাযহাব নয় । কারণ, অভিজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রই জানেন, অনেক হাদীসের সহীহ হওয়া না হওয়া নিয়ে হাদীস শাস্ত্রের ইমাম গণের মধ্যেই দ্বিমত রয়েছে ।

 এমনিভাবে একজন বললেন, এ সহীহ হাদীসই ইমামগণের মাযহাব । আরেকজন বলবেন, আরে এ হাদীসের বিশুদ্ধতা তো ইমামগণের জানা ছিল । তারা তো এটাকে মানসুখ বা রহিত বলে বিশ্বাস করতেন । তাই এটা তাদের মাযহাব নয় । এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষের অবস্থা হবে, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি ।

তাই ইমামগণের ঐ উক্তিটির বাস্তবতা বুঝে ব্যাখ্যা করতে হবে । এটাকে হাতিয়ার বানিয়ে মানুষকে ধোঁকায় ফেলা চরম অন্যায় আচরণ বলে বিবেচিত হবে ।

লেখক মুহাম্মদ মামুনুর রশিদ

উস্তাদ, হাদীস ও ফাতওয়া বিভাগ

তথ্যসূত্র: 

  • সহীহুল বুখারী 
  • সহীহুল মুসলিম 
  • সুনানে তিরমিযী 
  • এলামুল মুয়াক্বিয়ীন 
  • আল মাজমু (শরহে মুহায্যাব) 
  • হাশীয়ায়ে ইবনে আবেদীন আশশামী 
  • মাযহাব ও তাকলীদ কি ও কেন 
  • হাদীসের অনুসারীদের প্রতি 
  • তধাকথিত আহলে হাদীস ফিনার জবাব 
  • দলিলসহ নামাযের মাসায়েল 
  • উম্মাহর ঐক্য পথ ও পন্থা-যুগে যুগে আহলে হাদীস ইত্যাদি ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন