রমজান হোক পরিবর্তনের সময়। জানতে হলে ডট কম

রমজান হোক পরিবর্তনের সময়

রমজান আত্মশুদ্ধির মাস, তাকওয়া অর্জনের সোপান। এই পবিত্র মাসে রোজা শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকার নাম নয়, বরং আত্মসংযম, ইবাদত ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক মহান সুযোগ। রমজানের ফজিলত, আমল ও শিক্ষাকে কেন্দ্র করে এই লেখাটি সাজানো হয়েছে, যা আমাদের জীবন গঠনের পাথেয় হতে পারে। আসুন, রমজানকে কাজে লাগিয়ে আত্মশুদ্ধির পথে অগ্রসর হই।

পোশাকের পরিশুদ্ধি: রমজান হোক পরিবর্তনের সময়

কেন রমজানের রোজা ফরজ করা হয়েছে?

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফে এরশাদ করেন

يا ايها الذين امنوا كتب عليكم الصيام كما كتب على الذين من قبلكم لعلكم تتقون 

হে মুমিনেরা। তোমাদের উপর রোজাকে ফরজ করা হলো। যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যেন তোমরা তাকওয়া হাসিল করতে পারো।  সূরা বাকারা আয়াত নং ১৮৩।

একজন মুমিনের তাকওয়া আল্লাহ তায়ালার কাছে তার নৈকট্য ও মর্যাদা হাসিলের মানদন্ড। তাকওয়াবানদের সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ঘোষণা হচ্ছে لا خوف عليهم ولا هم يحزنون "দুনিয়াতে তাদের কোন ভয় নেই, আর আখেরাতে তাদের কোন  দুঃখ দুশ্চিন্তা নেই।" তাঁরা সফল, এবং হেদায়েতের উপর প্রতিষ্ঠিত। 

আর রমজানের রোজা আল্লাহ তা'আলা ফরজ করেছেন তাকওয়া হাসিল করার জন্য। 

রমজান মাসের বিশেষ ফজিলত:

রমজান মাস গুনাহ মাফের মাস। এই মাস আল্লাহর এবাদতে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার মাস। সহীহ বুখারীর ৩৭  নং হাদিস। 

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন। 

من صام رمضان ايمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبك

অর্থ: যে ঈমানের সাথে সওয়াব লাভের আশায় রামাযানের রোজা রাখে, তার পূর্ববর্তী গুনাহ গুলো মাফ করে দেয়া হয়।  সহীহ বুখারীর ৩৮ নং হাদিস। 

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন। 

من قام رمضان ايمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبك 

যে ঈমানের সাথে ও সওয়াব লাভের আশায় রমজানের রাতে তারাবির নামাজ পড়বে, তার পূর্ববর্তী গুনাহ সমূহ মাফ করে দেয়া হবে। অবশ্য কবিরা গুনাহের জন্য তওবা  করা আবশ্যক। 

তওবা কবুলের শর্ত তিনটি:

  1. কৃত গুনাহ ছেড়ে দেয়া 
  2. আল্লাহর কাছে লজ্জিত হওয়া 
  3. ভবিষ্যতে উক্ত গুনাহ না করার দৃঢ় অঙ্গীকার করা। 

গুনাহে ভরা আমাদের জীবন। কখনো হতাশার কালো মেঘে অন্ধকার হয়ে উঠে হৃদয় আকাশ। অনুশোচনার চাপা যন্ত্রণায় নিষ্পেষিত হয় হৃদয় মন। ফেলে আসা জীবনের পাপ পঙ্কিলতা মনে হলে ফুপিয়ে কান্না আসে। হারাম সম্পর্কের কথাগুলো মনে হলে চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। কিন্তু আমরা হতাশ হবো না।আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-

الا الذين تابوا واصلحوا واعتصموا بالله واخلصوا دينهم لله فاولئك مع المؤمنين.وسوف يؤتي الله المؤمنين اجرا عظيما. 

অর্থাৎ "যারা তওবা করে নিজেদের অবস্থার সংশোধন করে, আর আল্লাহকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে,এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে তাদের দ্বীনে একনিষ্ঠ থাকে, তারা মুমিনদের সঙ্গেই থাকবে এবং আল্লাহ তাআলা মুমিনগণকে অবশ্যই মহাপুরুষ্কার দিবেন"।  সূরা নিসা আয়াত নং ১৪৭।

আল্লাহতালা আমাদের সকলকে খাঁটি দিলে তওবা করে নিজেদের সকল পাপ পঙ্কিলতা মুছে ফেলার তাওফিক দান করুন। কারণ যে ব্যক্তি রমজান পেল, অথচ গুনাহ ক্ষমা করাতে পারল না। তার ব্যাপারে জিব্রাইল আলাইহিস সালাম বদদোয়া করেছেন।এবং আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া  সাল্লাম আমীন বলেছেন।

রমজান মাসে আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন কিছু আয়োজন চলতে থাকে যা মুমিন বান্দাকে তাকওয়ার পথে চলতে সাহায্য করে।  তিরমিজি শরীফের ৬৮২ নং হাদিস

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বলেছেন। 

"রমজানের প্রথম রাত আসলে শয়তান ও বিদ্রোহী জ্বীনদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। জাহান্নামের সব দরজা বন্ধ করা হয়। একটিও খোলা থাকে না। জান্নাতের সব দরজা খুলে দেয়া হয়। একটিও বন্ধ থাকে না।

 একজন ঘোষক ঘোষণা করতে থাকেন-হে কল্যাণের সন্ধানী!তুমি অগ্রসর হও। আর হে অকল্যাণের সন্ধানী!! তুমি থেমে যাও। আর আল্লাহ তাআলা বেশ কিছু মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। এভাবেই চলতে থাকে"। 

লাইলাতুল কদর:

এ মাসের একটি বিশেষ রাত লাইলাতুল কদর। রাত্রিটি অনির্দিষ্ট। তবে  রমজানের শেষ দশকের যে কোন বেজোড় রাতে হয়ে থাকে। 

এই রাত সম্পর্কে কোরআনে ঘোষণা হচ্ছে- 

ليله القدر خير من الف شهر 

অর্থ:"লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ"।  সুনানে ইবনে মাজাহর ১৬৪৪ হাদিস। 

আরেক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন। 

"রমজান মাস তোমাদের কাছে এসেছে। তাতে একটি রাত আছে, যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। এই রাতেও যে বঞ্চিত থাকবে,সে যাবতীয় কল্যাণ থেকে বঞ্চিত থাকবে।যে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে সে প্রকৃত অর্থে বঞ্চিত"।

রমজান মাসের গুরুত্বপূর্ণ আমল

১. কোরআন তেলাওয়াত:

এই মাসের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ হল অধিক পরিমাণে কোরআন পাঠ করা।

কেননা কোরআনের তেলাওয়াত দিলের ঝং তথা গুনাহের কালিমা মুছে দেয়। আত্মাকে প্রশান্ত করে। ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি এবং মানসিক প্রশান্তি দান করে। 

◾সহিহ বুখারীর হাদিসে এসেছে।

"তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ঐ ব্যক্তি যে কুরআন মাজীদ শিক্ষা করে এবং শিক্ষা দেয়"।

◾মুসলিম শরীফের এক হাদীসে এসেছে। 

নবীজি বলেন।" তোমরা কোরআন পাঠ কর।কেননা কোরআন তোমাদের জন্য কেয়ামতের দিন সুপারিশকারী হবে"।

 ◾তিরমিজী শরীফে এসেছে।

"যে ব্যক্তি কোরআনের একটি হরফ পাঠ করবে তাকে দশটি নেকি দেয়া হবে"।

আমরা জানি,রমজানে একে সত্তর। 

সুতরাং রমজানে একটি হরফে ৭০০ নেকি পাওয়া যাবে।

২. ইফতার করানো:

মজানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল মানবতার সেবা করা। অন্যকে ইফতার করানো। 

◾সুনানে ইবনে মাজাহ এর ১৭৪৭ নং হাদিস। 

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বলেন-

"তোমরা রোজাদারকে ইফতার করাও যদিও তা একটি খেজুর বা এক চুমুক পানি দ্বারা হয়"।

◾সহীহ ইবনে খুজাইমা এর ১৮৮৭ নং হাদিস। 

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বলেন-

রোজাদার কে ইফতার করানো হলো, গুনাহ মাফ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায়।

অথচ আমরা কি করছি:

আমাদের দুর্ভাগ্য বলা চলে। আমরা নিয়ম রক্ষার্থে রোজা রাখি। অথচ রমজানের গুরুত্ব ও ফজিলত ও তাৎপর্যের কথা অনুধাবন করি না। রোজা রাখি কিন্তু গুনাহ করি। 

ফেসবুক, ইউটিউব, মেসেঞ্জার আর ইনস্টাগ্রামে সময় নষ্ট করি । নাটক, মুভি, সিনেমা, আর নীল জগতের নোংরা দৃশ্যগুলো দেখে দেখে চোখ জুড়াই। শপিংমল আর মার্কেট গুলোতে কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকি। অবৈধ ও হারাম রিলেশন চালিয়ে যাই। নেট দুনিয়ার অন্ধকার জগতে ঘোরাফেরা করি। 

পর্দাহীনতা আর কুদৃষ্টির বেড়াজালে আবদ্ধ হই। হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার, চোগলখোরী, হারাম উপার্জন, মাদকদ্রব্য গ্রহণ, আর মিথ্যার পরসা সাজিয়ে রমজানকে কাটিয়ে দেই।  মানব বিধ্বংসী পশ্চিমা মতবাদকে প্রমোট করতে গিয়ে ধর্মীয় মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলি।

বুখারী শরীফের ১৯০৩নং হাদিসে এসেছে.

من لم يدع قول الزور والعمل به فليس له حاجه في ان يدع طعامه وشرابه 

"যে রোজা রেখে মিথ্যা কথা ও পাপ কাজ ছাড়তে পারেনি সে পানাহার করুক,এরও কোন প্রয়োজন আল্লাহর নেই"। 

সহীহ বুখারীর ১৯০৪ হাদিসের বর্ণনা 

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বলেন। 

"যদি তোমাদের কেউ রোজা রাখে, তাহলে সে অশ্লীল আচরণ ও শোরগোল করবে না। যদি কেউ তাকে গালি দেয় বা তার সাথে ঝগড়া করে, তাহলে সে বলবে- আমি রোজাদার"। 

সুতরাং আসুন আমরা আমাদের রমাদানকে সিয়াম পালন, তারাবির নামাজ, তাহাজ্জুদের সালাত, নফল দান সাদাকা, উত্তম আচরণ, গুনাহ মুক্ত জীবন, যিকির আযকার, মানবতার সেবা এবং বেশি বেশি কোরআন পাঠের মাধ্যমে সাজিয়ে তুলি।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে আমল করার তৌফিক দান করুক আমিন।

মোহাম্মদ উল্লাহ।  শিক্ষার্থী - জামিয়া রাব্বানিয়া আরাবিয়া।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন