ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিধান হল যাকাত। অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষা এবং সম্পদের সুষ্ঠু বন্টনের জন্য এই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
যাকাতের পরিচিতি: যাকাত কাকে বলে?
শাব্দিক বিশ্লেষণ:
যাকাত শব্দের অর্থ বৃদ্ধি পবিত্রতা প্রশংসা ও বরকত ( ১) শব্দটির মূল অর্থ বৃদ্ধি ও বর্ধন ( ২)
যাকাত শব্দটি আলিফ লাম যুক্ত হয়ে কোরআনে কারীমে মোট 30 বার ব্যবহার হয়েছে আলিফ লাম ছাড়া তিন জায়গায় সালাতের সাথে যাকাতের উল্লেখ এসেছে 27 জায়গায় আটবার মক্কিসুরাসমূহের আর বাকি সব এসেছে মাদানী সূরাতে (৩)
পারিভাষিক বিশ্লেষণ:
কুয়েতের যাকাত হাউস এর আন্তর্জাতিক শরিয়া বোর্ড যাকাতের পরিচিতি পেশ করেছেন এভাবে-
مطلق على اداء حق يجب في اموال مخصوص على وجه مخصوص ويعتر في وجوبه الحول والنصاب.
অর্থাৎ যাকাত হল নির্দিষ্ট আর্থিক হক আদায়ের নাম যা নির্দিষ্ট সম্পদের নির্দিষ্ট পন্থায় আবশ্যক হয় ।এবং এটা আবশ্যক হয় বছর ও নির্ধারিত পরিমাণ সম্পদ হলে।
কোরআন ও হাদিসের দৃষ্টিতে যাকাতের বিধান:
যাকাত ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ কেউ যাকাতকে অস্বীকার করলে সে কাফির বলে গণ্য হবে আর যদি ফরজ অস্বীকার করে কিন্তু যাকাত আদায় না করে তাহলে এই কাজ হারাম ও কবীরা গুনাহ।
কুরআনে কারীমে যাকাতের বর্ণনা:
কুরআনে কারীমের ২৭ টি স্থানে নামাজের সাথে যাকাতের কথা এসেছে।
সূরা হজ্জের ৭৮ নং আয়াত।
فاقيموا الصلاه واتوا الزكاه واعتصموا بالله.
তোমরা নামাজ আদায় কর এবং যাকাত প্রদান কর এবং আল্লাহর রজ্জুকে মজবুত ভাবে আঁকড়ে ধরো।
আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে মাসুদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন-امرتكم باقامه الصلاه وايتاء الزكاه ومن لم يزك فلا صلاه
অর্থ তোমাদেরকে একই সাথে সালাত ও যাকাতের কথা বলা হয়েছে সুতরাং যে যাকাত আদায় করে না তার সালাত পূর্ণ হয় না।
হাদিসে যাকাতের বর্ণনা:
রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন بني الاسلام على خمس شهاده ان لا اله الا الله وان محمدا رسول الله واقام الصلاه وايتاء الزكاه وصوم رمضان وحج البيت من استطاع اليه سبيلا
অর্থ ইসলামের স্তম্ভ পাঁচটি।
আল্লাহকে এক বলে সাক্ষ্য দেয়া। মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল এই মর্মে সাক্ষ্য দেয়া।
নামাজ আদায় করা জাকাত প্রদান করা রমজানে রোজা রাখা এবং সামর্থ্য থাকলেআল্লাহর ঘরে হজ করা । সহি বুখারী খন্ড এক পৃষ্ঠা 6 সহিঃ মুসলিম খন্ড এক পৃষ্ঠা ৩২
যাকাতের মূল উদ্দেশ্য:
আসলে যাকাতের মূল উদ্দেশ্য হলো মন ও আত্মার পরিশুদ্ধি কৃপণতা ও স্বার্থপরতা থেকে মুক্তি এবং দারিদ্র্য নিপীড়িত মানবতার প্রতি ভ্রুক্ষেপহীনতা থেকে মনকে পবিত্র করা।
যাকাতের মূল কথা কোরআন হাদিসে বিভিন্নভাবে বিবৃত হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন-خذ من اموالهم صدقه تطهرهم وتزكيهم
অর্থ হে নবী আপনি তাদের সম্পদ থেকে যাকাত গ্রহণ করে তাদেরকে পবিত্র করেন এবং তাদের আত্মসংশোধন করেন।
যাকাতের আরেকটি উদ্দেশ্য হলো যাকাতের মাধ্যমে একটি কল্যাণকর ও ইনসাফ ভিত্তিক সম্পদ বন্টন ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
যার ফলে জনগণে নির্ভরতা অর্জন দরিদ্র গোষ্ঠীর মৌলিক বিষয়াদিপূরণ ও দুস্থ মানবতার সম্মানজনক জীবন যাপনের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
হাদিসে বর্ণিত আছে-ان الله قد فرض عليكم زكاه تؤخذ من اغنيائهم فترد على فقرائهم
অর্থ আল্লাহ তায়ালা তোমাদের উপর যাকাত ফরজ করেছেন যা তাদের ধনীদের থেকে গ্রহণ করা হবে এবং তাদের দরিদ্রদের কে তা দেয়া হবে। সহিঃ মুসলিম হাদিস নং ১৯।
সম্পদ যেন একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর হাতে কুক্ষিগত না হয় সেজন্য ইসলাম দুটি ব্যবস্থা নিয়েছে। যা আজকের এই পশ্চিমা আইনে নেই। বিশেষত সেকুলার পন্থীরা কখনো সেটা কল্পনাও করতে পারে না। সেটা হল:
- বাধ্যতামূলক দান ।
- ঐচ্ছিক নফল দান।
যাকাত আদায়য়ের উপকারিতা:
যাকাত আদায়ে অনেক সব অর্জন হয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন
وما اتيتكم من زكاه تريدون وجه الله فاولئك هم المضعفون
অর্থ পক্ষান্তরে আল্লাহর সন্তুষ্ট লাভের আশায় পবিত্র অন্তরে যারা (যাকাত ও দান সদকা)দিয়ে থাকে এতএফ তারাই দ্বিগুণ সওয়াব পাবে।
যাকাত সদাকা আল্লাহর ক্রোধ নিভিয়ে দেয় এবং অপমৃত্যু রোধ করে। হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত নবীজি বলেন -
ان الصدقه تطفئ غضب الرب وتدفع ميته السوء
নিশ্চয়ই সদাকা আল্লাহর ক্রোধ নিভিয়ে দেয় এবং বিপদজনক মৃত্যু রোধ করে । তিরমিজি হাদিস নং ৬৭৪
যাকাত আদায়ের দ্বারা সম্পদের অনিষ্ঠতা দূর হয়।
হাদিসে এসেছে -
من ادى زكاه ماله فقد ذهب عنه شره
অর্থ যে তার সম্পদের যাকাত আদায় করল সে তার থেকে সমস্ত অনিষ্টতা দূর করে নিল। সহি ইবনে খুজেইমা খণ্ডন ৪ পৃষ্ঠা নং ১৩
যাকাতের মাধ্যমে সম্পদ নিরাপদ থাকে
হাদিসে এসেছে -
حصنوا اموالكم بالزكاه
তোমরা যাকাত প্রদানের মাধ্যমে সম্পদকে নিরাপদ রাখো। আবু দাউদ হাদিস নং 105
যাকাতের মাধ্যমে সম্পদ বৃদ্ধি পায়
কুরআনে এসেছে -
يمحق الله الربا ويربي الصدقات
অর্থ আল্লাহ তায়ালা সুদকে নিষ্পেষিত করেন এবং সাদাকাত কে বাড়িয়ে দেন। সূরা বাকারা আয়াত নং ২৭৬।
যাকাত আদায় না করার ভয়াবহতা:
পরকালীন আজাব; উত্তপ্ত আগুনের সতর্কতা।
কুরআনে এসেছে:
والذين يكنزون الذهب والفضه ولا ينفقونها في سبيل الله فبشرهم بعذاب اليم يوم يحمى عليها في نار جهنم فتكوى بها جباههم وجنوبهم وظهورهم هذا ما كنزتم لانفسكم فذوقوا ما كنتم تكنزون سوره التوبه الايه 34
অর্থ- যারা সোনা-রুপা পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে যন্ত্রণাময় শাস্তির ‘সুসংবাদ’ দাও।যে দিন সে ধন-সম্পদ জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে, তারপর তা দ্বারা তাদের কপাল, তাদের পাঁজর ও পিঠে দাগ দেওয়া হবে (এবং বলা হবে) এই হচ্ছে সেই সম্পদ, যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জীভূত করতে। সুতরাং তোমরা যে সম্পদ পুঞ্জীভূত করতে, তার মজা ভোগ কর।
বিষ ধর সাপের দংশন:
হাদিসে এসেছে-
من اتاه مالا فلم يؤذي زكاته مثل له يوم القيامه شجاعا اقرع له زبيبتان يطوقه يوم القيامه ثم ياخذ بلهزمته يعني بشدقيه ويقول انا مالك وانا كنزك
আবূ হুরাইরা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তিকে আল্লাহ ধন-মাল দান করেছেন; কিন্তু সে ব্যক্তি তার সেই ধন-মালের যাকাত আদায় করে না, কিয়ামতের দিন (আযাবের) জন্য তার সমস্ত ধন-মালকে একটি মাথায় টাক পড়া (অতি বিষাক্ত সাপের রূপ ধারণ করে তার গলায় পেঁচিয়ে থাকবে এবং যাকাত পরিত্যাগকারীর দুই চোয়ালে ধরে বলতে থাকবে আমি তোমার সম্পদ এবং আমি তোমার সঞ্চয়।
উপসংহার
যাকাত ইসলামের একটি অপরিহার্য বিধান, যা কেবল সম্পদের পবিত্রতা ও বৃদ্ধি নিশ্চিত করে না, বরং সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোরআন ও হাদিসে বারবার যাকাতের তাৎপর্য এবং এর আধ্যাত্মিক ও সামাজিক উপকারিতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এটি মানুষের মন থেকে কৃপণতা ও স্বার্থপরতা দূর করে, দরিদ্রদের প্রতি সহানুভূতি জাগায় এবং সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টনের মাধ্যমে একটি কল্যাণময় সমাজ গঠনে সহায়তা করে। যাকাত আদায়ের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পাশাপাশি দুনিয়া ও আখিরাতে অশেষ নেকি লাভ করতে পারি। অপরদিকে, যাকাত পরিহার করা কঠিন শাস্তির কারণ হতে পারে। তাই, প্রত্যেক মুসলিমের উচিত এই ফরজ ইবাদত যথাযথভাবে পালন করে নিজের ও সমাজের কল্যাণ নিশ্চিত করা।
শায়খ মোহাম্মদুল্লাহ। মাস্টার্স ইন ইসলামিক গবেষণা