ইলমে দিন অর্জনের জন্য তিনটি গুরুত্বপুর্ন শর্ত। সৈয়দ আলী নদভী রহ.

প্রিয় পাঠক! আজ আমরা দ্বীনি ইল্‌ম-এর তালিবে ইলম ও আলিমগণের জন্য তিনটি চিরন্তন শর্ত নিয়ে রচিত মুফাক্কিরে ইসলাম আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদাৰী রহ. এর প্রসিদ্ধ আরবি একটি লেখার বাংলা অনুবাদ শেয়ার করছি যা প্রিয় তালিবে ইলম ও আলেমদের জন্য খুবই উপকারী হবে। হযরত নদবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর লেখাটি নিম্নরূপ।

ইলমে দিন অর্জনের জন্য তিনটি গুরুত্বপুর্ন শর্ত

ইলমে দিন অর্জনের জন্য গুরুত্বপুর্ন শর্তসমূহ

ভূমিকা প্রিয় তালিবানে ইল্‌ম !

একথা আপনারা বারবার শুনে থাকবেন, যুগের পরিবর্তন হয়েছে, পৃথিবী বদলে গেছে, বদলে গেছে আসমান-জমিন, পরিবর্তন হয়েছে চিন্তা করার প্রকৃতি ও ধরন । এমন একটি যুগে দ্বীনী ইলম হাসিল করার উদ্দেশ্যে সময় ক্ষেপণ, তাতে অভিজ্ঞতা অর্জন, তার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয় অনুধাবনে মস্তিষ্ক উত্তপ্তকরণ হচ্ছে শীতকালে বাসন্তী সুরে বাঁশী বাজানো কিংবা পাহাড় খুঁড়ে কুটা সংগ্রহের তুল্য । কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, শুধু বর্তমান যুগেই নয়, বিগত সব যুগেই সময়ের বিবর্তনের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে । যে কোন যুগের সাহিত্য ও কাব্য চর্চার ইতিহাস পড়ে দেখুন, সর্বত্রই শ্রুতিগোচর হবে একই কান্নার সুর ঃ যুগ নষ্ট হয়ে গেছে, ‘ইলমের কদর নেই, জ্ঞানী-দ্বীনী জনের মর্যাদা নেই, সর্বত্রই চলছে অজ্ঞতা ও অনভিজ্ঞতার জয়জয়কার । 

যুগের নামে অভিযোগ ও ফরিয়াদ করে রচিত কবিতায় ভরে রয়েছে কাব্যগ্রন্থের পাতার পর পাতা । যে কোন কিতাব উল্টিয়ে দেখুন, তাতে রয়েছে সময়ের অবিচারের আহাজারী, অভিযোগের স্তূপ । আর সে সবের মূল সুর একটাই । কার সামনে উপস্থিত করব জ্ঞান-ভাণ্ডার? উজাড় করব অমূল্য বাণী? কে বুঝবে রত্নের কদর? কে দেবে অমূল্য সম্পদের যথার্থ মূল্য? অপগণ্ড আর অযোগ্যদের প্রবল প্রতিপত্তির যুগে মানুষ কার জন্য করবে শ্রম সাধনা? কেন পানি করে দেবে পিত্ত? কলিজার খুন ঝরাবে কার স্বার্থে? কিন্তু মনে রাখবেন, এসব অভিযোগ যদি আপনার মনে দাগ কেটে রাখে তাহলে আপনার র"চি হবে না মাদরাসায় অবস্থানের, ইচ্ছা হবে না মেহনত করে কিছু শিখতে ।

মনে রাখবেন! কালের বিবর্তন একটি বাস্তব ও অনস্বীকার্য সত্য । এক শতাব্দী পেছনে তাকিয়ে দেখুন, কত খায়র ও বরকতে (মঙ্গল ও কল্যাণে) পরিপূর্ণ ছিল সে যুগ। সে যুগের (বুযূর্গদের) বিশিষ্টদের কথা তো স্বতন্ত্র; সাধারণ লোকেরাও ছিল এ যুগের বিশিষ্টদের তুলনায় শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী । তাঁদের ঈমানী তেজ, ধর্মীয় মর্যাদাবোধ ছিল কত অধিক! দ্বীনের ‘ইলম হাসিল করা, নর-নারী নির্বিশেষে প্রত্যেকের হাফিজ-ই কুরআন হওয়ার প্রচলন কত ব্যাপক ছিল! আজ প্রভাব বিস্তার করেছে উদাসীনতা ও বস্তুবাদ । ক্ষীণ ও দূর্বল হয়ে গেছে দ্বীনী ‘ইম-এর অনুপ্রেরণা ও উদ্দীপনা । 

কিন্তু অতীতে সংঘটিত, বর্তমানে ঘটমান ও ভবিষ্যতে সংঘঠিতব্য এ বিবর্তন, যার গতি-প্রকৃতি আল্লাহ্ পাকই সমধিক অবগত-এর আবহমান ধারা সত্ত্বেও আমি বলতে চাই আল্লাহর বিধান অপরিবর্তনীয় । যুগের বিবর্তন সে বিধানের কোন রদবদল ঘটাতে পারে না । আল-কুরআন যে আয়াতে এ বিধানের ঘোষণা দিয়েছে তাতে পবিত্র কুরআনের অনুসৃত সাধারণ বর্ণনাশৈলীর ব্যতিক্রম করে বিষয়টির পুনরুল্লেখ ও পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে ঃ

ولن تجد لسنة الله تبديلا ولن تجد لسنة الله تحويلا

আল্লাহর বিধানে তুমি কখনো রদবদল দেখতে পাবে না এবং আল্লাহর বিধানে তুমি কস্মিনকালেও বিবর্তন প্রত্যক্ষ

করবে না।

আল্লাহ্ তা'য়ালা তাঁর কামিল কুদরত ও পরিপূর্ণ বিজ্ঞতার ভিত্তিতে বিশ্বজগত ও মানব ‘ফিরাত; (স্বভাববিধি)-এর জন্য যে বিধিমালা নির্ণীত করেছেন, যে নীতি স্থির করে রেখেছেন, কিয়ামত পর্যন্ত তাতে কোন রদবদল হবে না । আল-কুরআনের পূর্বাপর অনুসন্ধানী ও হাদীসসমূহের সুগভীর অধ্যয়নের মাধ্যমে অবগতি লাভ করা যেতে পারে সেসব মৌলিক বিধানের । 

সে বিধিমালার তালিকা সুদীর্ঘ । আমার মত নগণ্য তালিব-ই ‘ইলমের পক্ষে সে তালিকা প্রদান সাধ্যাতীত আর সময়ও সে উদ্দেশ্য সাধনে সংকীর্ণতর । তবুও আমার অসম্পূর্ণ বিদ্যার পরিসর হতে এমন তিনটি বিধানের উল্লেখ করছি যা আমাদের জীবন ও আমাদের মাদরাসাগুলোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে বিশেষভাবে সম্পৃক্ত ।

প্রিয় পাঠক তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত নিচে দেওয়া হল

প্রথম শর্ত উপকারীর মর্যাদার স্বীকৃতি 

আল্লাহর বিধানসমূহের একটি হলো কল্যাণকর ও লাভজনক বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া, তার মর্যাদার স্বীকৃতি দেয়া । উপকারী বিষয়, তার ক্ষেত্র ও কেন্দ্রের প্রতি আসক্তি, উপকারীর খোঁজে লেগে থাকা, তার দিকে ধাবিত হওয়া ও তা পেয়ে গেলে তার কদর করা মানুষের স্বভাব । আল্লাহ্ পাক লাভজনক বিষয়ের স্থায়িত্ব, তার জীবন্ত থাকা ও সজীব থাকার গ্যারান্টি দিয়েছেন । লাভশূন্য বিষয়ের জন্য নেই এমন কোন গ্যারান্টি । 

সূরা আর রা'দ-এ এসেছে এ বিষয়ের সুস্পষ্ট ভাষ্য : (বান বন্যায় ভেসে আসা) আবর্জনাগুলো বিলীন হয়ে যায় শুকিয়ে, আর যা উপকারী (পানি) তা সঞ্চিত হয় ভূ-গর্ভে। আল্লাহ্ এভাবে দৃষ্টান্ত পেশ করেন লাভ-অলাভ ও কল্যাণ-অকল্যাণের যাতে তোমরা তা অনুধাবন করতে পার ।

একটি বিষয় লক্ষ্য করুন ‘অধিক উপযোগী বলা হয়নি, বরং আল-কুরআনের পরিভাষা হলো ‘উপকারী’। এ উপকারীর স্থায়িত্বের বিধান চলে আসছে লাখ লাখ বছর ধরে এবং হাজারো রকমের বিবর্তন সত্ত্বেও তা থাকবে অপরিবর্তনীয় । উন্নতি, অগ্রগতি, গুরুত্ব ও মূল্যমানের স্বীকৃতি লিখে দেয়া হয়েছে উপকারীর ললাটে। সুতরাং উপকারী সত্তারুপে গড়ে ওঠা নিশ্চয়তা দান করে অগণিত বিরুদ্ধাচরণ ও অসংখ্য বিপদ মুকাবিলায় হেফাজতের। তার প্রয়োজন পড়ে না প্রচার-পাবলিসিটির । কেননা খোদ উপকারী সত্তায় বিদ্যমান থাকে প্রেমাস্পদ হওয়ার গুণ । এবং তাতে থাকে না স্থান কাল পাত্র ও দেশ-জাতির ব্যবধান । 

উপকারী যদি আত্মগোপন করে থাকে পাহাড় চূড়ায়, তবুও পৃথিবী তার সন্ধানে পৌঁছে যাবে সে দুর্গম মযিলে আর তাকে সম্মানের সাথে তুলে নেবে মাথার ওপর, বরং সাগ্রহে সাদরে অধিষ্ঠিত করবে চোখের মণিতে । এ হচ্ছে আল্লাহ্র বিধান এবং হাজারো লাখো বছরের অলঙ্ঘনীয় অপরিবর্তনীয় বিধান ।

আপনি যুগের কাছ থেকে আপনার কল্যাণকর ও উপকারী হওয়ার স্বীকৃতি আদায় করুন, সমকালীনদের এ কথা মেনে নিতে বাধ্য করুন, আপনার সঞ্চিত ‘ইলম দুনিয়ার হাতে নেই । আমি মনে করি, এ পন্থা আপনার হাজারো সমস্যার সমাধান । যে দোকানে যে সওদা পাওয়া যায় তা কেনার জন্য সেখানে যাওয়াই পৃথিবীর নিয়ম । কোন যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিও এমন অধিকতর যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির কাছে যাতায়ত করে যার কাছে মনের খোরাক ও রোগের ঔষধ পাওয়া যায় ।

দ্বিতীয় শর্ত স্বনির্ভরতা ও নিস্বার্থপরতার শক্তি অপরিসীম

দ্বিতীয় বিষয়টি হলো আত্মনির্ভরতা ও স্বার্থত্যাগ । এটাও আল্লাহর অপরিবর্তনীয় বিধান, যারা হাত পাতে, মানুষ তাদের থেকে দূরে সরে যায় । যারা আঁচল পেতে ধরে, তাদের দেখলে মানুষ পালিয়ে যায়, আরা যারা নিজের মুষ্টি বন্ধ করে রাখে, আঁচল গুটিয়ে রাখে, লোকেরা তাদের পদচুম্বন করে এবং খোশামোদ করে কিছু গ্রহণ করাতে পারলে ধন্য হয়ে যায়! অনাদিকাল থেকে আত্মনির্ভরতা ও স্বাবলম্বিতায় নিহিত রয়েছে আকর্ষণ ও জনপ্রিয়তা আর হাত পাতায় রয়েছে অপমান ও বেইজ্জতি । 

যে স্বনির্ভর, সকলে তার মুখাপেক্ষী আর যে পরনির্ভর, সকলে তার প্রতি তোয়াক্কাবিহীন । আল্লাহর এ বিধানও চিরন্তন । সময়ের বিবর্তনে তাতে আনেনি কোন পরিবর্তন । চতুর্থ শতকের ইতিহাস পড়ুন,

সেখানে একই অবস্থা, ইতিহাস পড়ুন অষ্টম শতকের, সেখানেও বিরাজমান একই অবস্থা, আর আজকে এ চতুর্দশ শতকেও সে বিধান অপরিবর্তিত । সব যুগেই আপনি পাবেন অভিন্ন ধারার ঘটনাপঞ্জী । অধিক ঘটনা বা বিশদ বর্ণনার অবতারণা করতে চাই না । 

বুযুর্গানে দ্বীনের জীবন-চরিত ও তাসাওউফের ইতিহাস ভরা রয়েছে এসব ঘটনায় । এ বিষয়ে আপনাদের সম্ভবত রয়েছে নিজস্ব অভিজ্ঞতা কিংবা আপনারা উস্তাদ ও মুরুব্বীদের কাছে শুনে থাকবেন তাঁদের উস্তাদ বুযুর্গানে দীনের ঘটনাবলী ।

তৃতীয় শর্ত পরিপূর্ণতা অর্জন মর্যাদার চাবিকাঠি

তৃতীয় ও শেষ বিষয় হলো, সম্পূর্ণতা, অনন্যতা, পারদর্শিতা ও কোন বিষয়ে পরিপূর্ণ দক্ষতা লাভ । উর্ধ্ব জাগতিক মহাজ্ঞান তো বটেই, জাগতিক শাস্ত্রীয় বিদ্যায়ও যদি কেউ পরিপূর্ণতা অর্জন করতে পারে, বরং আরো নিম্নমানের ব্যবহারিক কোন বিষয়ে, যথা ঃ হস্তাক্ষর শিল্পে, বাইন্ডিং শিল্পে দক্ষতা অর্জন করে তাহলে কত কত নামকরা বিদ্বানকে তাদের পেছনে ঘুরতে দেখা যায় । অনেক জ্ঞানী-গুণী-গ্রন্থকার, নামী-দামী পাবলিশার, কাতিব (হস্তাক্ষরশিল্পী) ও 

কম্পোজিটরদের অন্যায় আবদার ও মান-অভিমান সয়ে যায় । তদুপরি তাদের অনুনয় ও খোশামোদ করতে থাকে । উদ্দেশ্যে, যথাসময়ে লেখাটি শেষ করে দেয়া কিংবা অন্তত ব্লক তৈরির উদ্দেশ্যে গ্রন্থের নামটা আর্ট করে দেয়া । 

কোন বিষয়ে অনন্য বৈশিষ্ট্যসমৃদ্ধ কিংবা দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অধিকারী কোন ব্যক্তিকে যদি আপনি দেখেন কিংবা তার বিষয়ে শুনতে পান, বেকারত্ব ও অসচ্ছলতার অভিশাপে ভুগছে, তাহলে অবশ্যই আপনাকে মনে করতে হবে, সে গুণবান ব্যক্তির মাঝে রয়েছে এমন কোন দুর্বলতা কিংবা স্বভাব দোষ যা তার যাবতীয় গুণ ও যোগ্যতাকে পর্দাবৃত করে রেখেছে, তাতে পানি ঢেলে দিয়েছে । যেমন অতিশয় ক্রোধ, মেযাজের অস্থিরতা, অলসতা, পাঠ দানে অমনোযোগিতা, কর্মবিমুখতা, নিয়ম ভঙ্গের অভ্যাস, পরমতে অসহিষ্ণুতা ইত্যাদি কিংবা আরও অধিকতর মারাত্মকরূপে সে কিছুটা উন্মাদ বা আধা-পাগলা অথবা উত্তপ্ত স্বভাবের । 

তাই সে স্থির হতে পারে না কোথাও, ঝগড়া বাঁধিয়ে দেয় মুহূর্তে । নিশ্চিত তার মাঝে বিদ্যমান থাকবে এ ধরণের কোন উপকরণ যার পরিণতিস্বরূপ জগত তার কল্যাণ থেকে মাহরূম আর সে নিজে পরিত্যক্ত হয়েছে অবহেলা ও বিস্মৃতির অজ্ঞাত কোণে । এই হলো সেই তিনটি চিরন্তন শর্ত ও গুণ, যার ব্যাপারে বিধান হলো, যুগ যুগের বাসিন্দারা যতই বিগড়ে যাক, এ তিন গুণের যাদুকরিতা ও লোকপ্রিয়তা অক্ষুণ্ন রয়েছে এবং থাকবে ।

আমাদের মাদ্রাসাসমূহের ফারেগীন ও নববী ‘ইলমের তালিব (ছাত্রগণ)কে পূরণ করতে হবে এ তিনটি শর্ত, তাদের হতে হবে এ গুণাবলীতে গুণান্বিত ।

সূত্র : আলী নাদাবী (রহঃ)-এর উর্দূ বয়ানাতের অনুবাদ সংকলন বক্তৃতা সংকলন “প্রাচ্যের উপহার” নামক বই থেকে সার সংক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে । আল্লাহ্ কথাগুলোর প্রবক্তা অনুবাদক ও আমাদের সবাইকে উত্তম খাইর দান করেন । 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন