প্রিয় পাঠক! আজ আমরা কওমি মাদ্রাসার অবদানগুলো বিস্তারিত জানানোর চেষ্টা করব। আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে আমরা চেষ্টা করব যথাসম্ভব বিস্তারিতভাবে সর্ব দিক থেকে সুন্দরভাবে লেখার। তো সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন আশা করি অনেক কিছু জানতে পারবেন। ইনশাআল্লাহ।
ক্বওমী মাদ্রাসার অবদান
আমরা একটু পরে কওমি মাদ্রাসার অবদানগুলো কয়েক ধাপে উল্লেখ করছি। তবে এর পূর্বে আমরা কওমি মাদ্রাসার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরব। তারপর কওমি মাদ্রাসার অবদানগুলো সুন্দরভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে পয়েন্ট আকারে তুলে ধরব। ইনশাআল্লাহ।
ক্বওমী মাদ্রাসার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
মানবতার চারিত্রিক উন্নতি করতে যে শিক্ষা সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে তা হলো ইসলাম শিক্ষা, যে শিক্ষার অভাবে জাহিলি যুগের মানুষ হিংস্রতার নিম্নস্তরে অবতরণ করেছিল। এমন কোন অপকর্মই বাদ দেয় নাই যা হিংস্র প্রাণীকেও হার মানায়। সেই যুগের মানুষ নির্লজ্জতা, অপকর্ম, বেহায়াপনার এমন স্তরে পৌঁছে গিয়েছিল যার কারণে সেই যুগটাকেই বলা হত, আইয়্যামে জাহেলিয়্যা অর্থাৎ বর্বরতার যুগ।
আর সেই মানুষগুলোকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে দিয়েছে হেরা গুহার থেকে জ্যোতি তথা কোরআন শিক্ষার মাধ্যমে। কোরআনী শিক্ষা তাদেরকে এমন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল যেই স্তরে কেয়ামত পর্যন্ত আর কেউ পৌঁছতে পারবে না ।
তাই তো রাসূল (সা.) বলেছেন সর্বোত্তম যুগ আমার যুগ। তার পরে তার পরেরটা, তার পরে তার পরেরটা, সেই ইলমী শিক্ষা যা মানবতার সূচনালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত মানুষের বিবেক বুদ্ধিকে সুউচ্চ করতে মানুষের চিন্তা চেতনাকে পরিশুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। তা হল ইসলামী শিক্ষা। ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায়, সর্বপ্রথম হেরা গুহার প্রত্যাদেশের প্রশিক্ষণের নিমিত্তে মক্কায় সাফা পাহাড়ের নিকটস্থ দারে আরকামে মাদ্রাসা শিক্ষার সূচনা হয়।
হিজরতের পরে মসজিদে নববী হয়ে উঠে ইসলামী শিক্ষার ঐতিহাসিক প্রাণকেন্দ্র । সেই থেকেই মসজিদ কেন্দ্রিক আদর্শ শিক্ষার এ সুমহান ধারা। রাসূল (সা.)-এর ইন্তেকালের পরে খুলাফায়ে রাশেদিনের যুগে তাদের চেষ্টায় মাদ্রাসা শিক্ষার বিস্তার লাভ করে ক্রমান্বয় মদিনা, কুফা, বাগদাদ ও দামেস্ক দ্বীনী শিক্ষার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়।
ঐতিহাসিকগণ বাগদাদে নিজামূল মুলক তুশী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায়ে নিজামিয়াকেই প্রচলিত সিলেবাস ভিত্তিক ইসলামের ইতিহাসের প্রথম মাদ্রাসা বলে উল্লেখ করেন, এভাবে ইসলামী শিক্ষা ব্যাপক হারে চালু হতে থাকে। ভারত, মিশর, আফগা-ি নস্তান ও বাংলাদেশসহ পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ইসলামী শিক্ষার ব্যাপক প্রচলন শুরু হয় । ইতিহাসে পাওয়া যায় উপমহাদেশে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ও বাংলায় ৮০ হাজার ক্বওমী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠান ছিল। ঐ মাদ্রাসাগুলো নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত হত ।
পরবর্তীতে ইংরেজদের হস্তক্ষেপে ক্রমশ তা বিলুপ্ত হয়ে যায়। ভারত উপমহাদেশে ইসলামী শিক্ষার সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হয়। যার সুফল আজকের পৃথিবী শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছে। এই দারুল উলূম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠার পূর্বে সমগ্র উপমহাদেশ বৃটিশদের করাল গ্রাসে নিমজ্জিত ছিল । ইংরেজদের দুঃশাসন টিকিয়ে রাখার জন্য সবচেয়ে বড় বাধা দেখল আলেম উলামা । কারণ এই দেশের মানুষ আলেমদেরকে শ্রদ্ধা করে ধর্মগুরু মনে করে ।
তাদের কথায় তারা দুর্বার আন্দোলন করতে প্রস্তুত। তারা ক্রমেই দেখছিল বৃটিশ খেদাও আন্দোলন, পলাশীর যুদ্ধ, শামেলীর যুদ্ধ, রেশমী রোমাল আন্দোলন, সিপাহী বিপ্লব সহ বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিয়েছে আলেমগণ। তাই তারা বুঝে নিয়েছে যে, আদর্শে সচেতন সংগ্রামী আলেম সমাজ ও তাদের আদর্শ ভিত্তিক ইসলাম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা মসজিদ মাদ্রাসাগুলো চিরতরে বিলুপ্ত করতে না পারলে এদেশে ক্ষমতার মসনদ কিছুতেই টিকিয়ে রাখা যাবে না। কাজেই তারা এ সূত্র ধরে হাজার হাজার আলেমকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে শহীদ করে দেয়।
দিল্লির চাঁদনী থেকে খায়রাবাদ পর্যন্ত শেরশাহ গ্রান্ডট্রাঙ্ক রোডের এমন কোন বৃক্ষ বাকি ছিল না যাতে কোন আলেমের লাশ ঝুলেনি। হাজার হাজার আলেমকে আন্দামান, সাইপ্রাস, মাল্টা ও কালা পানিতে নির্বাসন দিয়ে বছরের পর বছর বন্দী করে রাখে। ১৮৫৭ সালের ১৮ই নভেম্বর দিল্লির জামে মসজিদের আঙ্গিনায় একই দিনে ২৭ হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হয়। এই সময় মোট ১০ লাখ মুসলমান শহীদ হয় । তার মধ্যে আলেমদের সংখ্যা ছিল ৫১,৫০০ জন ।
আলেমদেরকে অর্থনৈতিকভাবে পর্যুদস্ত করার মানসে তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে নেয়। জাতির এই বিভীষিকাময় পরিস্থিতি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে বিরাজমান সমস্যাগুলো সমাধা করে একাডেমী পন্থায় ও শিক্ষা মিশনের মাধ্যমে, বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের বলিষ্ঠ চেতনায় সমৃদ্ধ ও ইসলামি আদর্শ নৈতিকতা শিক্ষা সংস্কৃতি সংরক্ষণ করে জাতিকে একটি সুশীল সমাজ উপহার দেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে হুজুর (সা.)-এর নির্দেশে, কাসেম নানুতুবি (রহ.)-এর নেতৃত্বে ইসলা-ে মর উজ্জ্বল জ্যোতিস্ক পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ইসলামি বিদ্যাপিঠ, ভারতের দেওবন্দ অঞ্চলে ১৮৬৬ সালে দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হয়।
পরবর্তীতে তারই মতাদর্শে প্রতিষ্ঠিত হয় উপমহাদেশের সর্বত্র হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ ক্বওমী মাদ্রাসা। সুতরাং ক্বওমী মাদ্রাসা গতানুগতিক কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয় বরং তা হল জাতির জন্য একটি উত্তম আদর্শ। আর সে আদর্শকে সামনে রেখেই আজ একবিংশ শতাব্দির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে জাতির খেদমত করে আপন গতিতে সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছেন ।
আর এ জাতির উপর যে অমানবিক নির্যাতন চলছিল তা এখনও বন্ধ হয়নি এমন কি বাংলাদেশের উলামায়ে কেরাম ও তাদের দোসরদের অত্যাচার থেকে রেহাই পায়নি। বর্তমানেও আমাদের দেশের আলেমদের উপর অমানবিক নির্যাতন চালাচ্ছে। জঙ্গি অপবাদ দিয়ে হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। মাদ্রাসা তল্লাশির নামে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের উপর মিথ্যা মামলা আরোপ করা হচ্ছে। এ ছাড়াও বহুবিধ বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।
বাংলাদেশে কৃওমী মাদ্রাসার কিছু অবদান
কৃওমী মাদ্রাসা সর্বক্ষেত্রেই নিজের অবদান তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। সু-শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড; এ বাক্যটির যথাযথ ব্যবহার কৃওমী মাদ্রাসা শিক্ষা দিচ্ছে। বৃটিশ সরকার প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থা উৎখাত করে সার্বজনীন শিক্ষা ধারা প্রবর্তনের মহা পরিকল্পনা নিয়ে যুগোপযোগী সিলেবাস তৈরি করে এখানে পাঠ দান করা হয় ।
ধর্মীয় ক্ষেত্রে অবদান
বাংলাদেশ আজ বিশ্বের মানচিত্রে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ। আর এখানে প্রায় ২০ হাজার মাদ্রাসা রয়েছে। মক্তব রয়েছে লক্ষাধিক, মসজিদ প্রায় ৩ লাখ, এসবের নেপথ্যে কৃওমী আলেমদের ভূমিকা সর্বাগ্রে। এসব প্রতিষ্ঠানে অধিকাংশ ইমাম, খতিব, শিক্ষকমণ্ডলী হলেন কৃওমী আলেমগণ ।
এছাড়া আন্তর্জাতিক মানের হিফজ বিভাগও রয়েছে বহু। সারা বিশ্বে বহুবার ১ম বিজয়ের মালা ছিনিয়ে এনেছে বাংলাদেশের ছেলেরা। ইসলামী দেশগুলির সমন্বয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতা সম্মেলনে বাংলাদেশের স্থান প্রথম কাতারে ।
দাওয়াত ও তাবলীগের ক্ষেত্রে অবদান
পথভোলা মানুষদের মাঝে দ্বীনি প্রেরণা ও চেতনা সৃষ্টির লক্ষ্যে দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমে এক বিশেষ খেদমত আঞ্জাম দিচ্ছেন, যারা পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ইসলামের বাণী প্রচার করছে। এ তাবলীগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মাওঃ ইলিয়াস (রহ.) কৃওমী মাদ্রাসারই একজন আলেম। এছাড়া হক্কানী পীর মাশায়েখ, তলাবা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, সাধারণ শ্রমজীবি মানুষ এ কাজে অংশগ্রহণ করে ফায়দা অর্জন করছে।
গ্রন্থনা ও প্রকাশনায় অবদান
ইসলামের বাণী ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে সকল শ্রেণীর মানুষের ইসলামী জ্ঞান সমৃদ্ধশীল করতে ক্বওমী আলেমগণ অসাধারণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। কোরআন তাফসীর অনুবাদ, ইসলামী ইতিহাস, মনীষীদের আদর্শ জীবনী সংবলিত বই লিখে ও অনুবাদ করে জাতির বিরাট খেদমত আঞ্জাম দিচ্ছেন।
ভ্রান্ত মতবাদ দমনে আলেমদের অবদান
জাতিকে ইসলামের পথে পরিচালিত করতে কৃওমী আলেমগণ বাতিল কু-সংস্কার প্রতিরোধে চির আপোষহীন। তারা নাস্তিক, মুরতাদ, কাদিয়ানী, দেওয়ানবাগী, আটরশী, মওদুদী, ভাণ্ডারী, বেরলভী, বেদআতী, লামাযহাবী ও শিয়াসহ অন্যান্য বাতিল সম্প্রদায়ের ভ্রষ্টতা সম্পর্কে সতর্ক করে থাকেন।
রাজনৈতিক অঙ্গনে অবদান
বাংলাদেশ তথা সমগ্র বিশ্বে রাজনৈতিক অঙ্গনেও ক্বওমী আলেমগণ বেশ অগ্রগামী। বর্তমানে আলেমদের জমিয়াতে উলামায়ে ইসলাম, খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও ইসলামী মোর্চাসহ অনেক রাজনৈতিক সংগঠন রয়েছে।
সোনালী ব্যক্তিত্ব গড়ার অবদান
ক্বওমী শিক্ষা গ্রহণ করে অধিকাংশই সোনালী মানুষে রূপান্তরিত হয়। (তবে কিছু তো এর ব্যতিক্রম হবেই) আর কোরআন হাদিসের দৃষ্টিতে আলেমরাই সমাজে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি ও আলেম সমাজই স্মরণীয় বরণীয়। ইসলামী শিক্ষাই এমন এক শিক্ষা ধারা যার দ্বারা মানুষ সর্বক্ষেত্রে উপকৃত ও সফলকাম হতে পারে আর এই অতুলনীয় শিক্ষা আমাদেরকে উপহার দিয়েছে নক্ষত্র তুল্য হাজী ইমদাদুল্লাহ মোহাজিরে মক্কী (রহ.), আশ্রাফ আলী থানভী (রহ.), হুসাইন আহমদ মাদানী (রহ.), শামসুল হক ফরীদপুরী (রহ.), মুহাম্মদুল্লাহ হাফিজ্জি হুজুর (রহ.), শাইখুল হাদিস আজিজুল হক (রহ.), মুফতী ফজলুল হক আমিনী (রহ.), সৈয়দ মাওঃ ফজলুল করীম পীর সাহেব (রহ.), সুলতান আহমদ নানুপুরী (রহ.), আল্লামা শাহ আহমদ শফী দা. বা., মহিউস সুন্নাহ মাহমুদুল হাসান দা. বা. আল্লামা মুফতী আ. হাকীম (শায়খুল হাদিস দারুস সালাম মাদ্রাসা) আল্লামা আশ্রাফ আলী দা. বা. প্রমুখ উলামায়ে কিরাম ।
উপসংহার
তাই যেই শিক্ষা আমাদের প্রকৃত কল্যাণ বয়ে আনবে, যার মাধ্যমে ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ বয়ে আনা সম্ভব, যার মাধ্যমে মানব জাতির মুক্তি সম্ভব, সেই শিক্ষার প্রতি সরকারের উচ্চপদের সকল কর্মচারী, সুশীল সমাজ ও সর্বস্তরের জনগণের সু-দৃষ্টি কামনা করছি।