কওমী মাদরাসার ইতিহাস ঐতিহ্য ও অবদান ও কিছু বিভ্রান্তির অবসান

প্রিয় পাঠক আজকের আর্টিকেলে আমরা কওমি মাদ্রাসার গোড়া থেকে নিয়ে অদ্যপতি আজ পর্যন্ত সম্পূর্ণ ইতিহাসটা আপনাদের সামনে নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরব এবং কওমি মাদ্রাসার অবদান এবং কওমি মাদ্রাসা নিয়ে যত ধরনের বিভ্রান্তি সমাজের ছড়িয়ে যাচ্ছে সমস্ত প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করব ইনশাল্লাহ। আশা করি আপনাদের নিকট আমাদের আর্টিকেলটি খুবই ভালো লাগবে।

কওমী মাদরাসার ইতিহাস ঐতিহ্য ও অবদান

কওমী মাদরাসার ইতিহাস ঐতিহ্য ও অবদান

কওমী মাদরাসা

কওম আরবি শব্দ, যার অর্থ জাতি। ফার্সি ও উর্দূ ভাষাতেও কওম জাতি অর্থে ব্যবহৃত হয়। মাদরাসা এটিও আরবি শব্দ। যার অর্থ বিদ্যালয় বা শিক্ষালয়। কওমী মাদরাসা অর্থ হলো জাতীয় শিক্ষালয়। জাতির প্রয়োজনকে সামনে রেখে জাতির সার্বিক সমস্যাবলীর সমাধান ও সার্বিক কল্যাণ সাধন এবং সর্বোপরি জাতির ঈমান-আক্বীদা, তাহযীব-তামাদ্দুন হেফাজত ও মুসলিম উম্মাহর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার মহান লক্ষ্যকে সামনে রেখে মুসলিম উম্মাহর স্বীয় স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে বলে এ জাতীয় মাদরাসাগুলোকে কওমী মাদরাসা বলা হয়। 

ইলমে দ্বীন, ইলমে ওহী অথবা সন্দেহাতীত নির্ভুল জ্ঞানের চর্চা শুরু হয় নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে। যার ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে পৃথিবীতে আসে সর্বশেষ ওহীর জ্ঞান। কোরআনে পাক ও সুন্নাহর জ্ঞান মদীনা মুনাওয়ারায় বসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবায়ে কেরামকে দান করেন। মদীনা মুনাওয়ারায় উক্ত সুফ্ফা মাদরাসার প্রথম শিক্ষক হিসেবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত মুসআব ইবনে উমাইর রা. কে প্রেরণ করেছিলেন। হিজরতের পর এখানেই সাহাবায়ে কেরামকে দ্বীনি তালীম দেয়া হত। যাঁর একজন ছাত্রের নাম হযরত আবু হুরাইরা রা.। যার থেকে বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৫৩৭৪ টি

কওমী মাদরাসার সূচনা

নবজীবনের ইহ ও পারলৌকিক প্রয়োজন সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার জন্য কুরআন ও হাদীসের শিক্ষা তথা ইসলামী শিক্ষার বিকল্প নেই । এ শিক্ষা ছাড়া পৃথিবীতে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না । এ শিক্ষা হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু হয়ে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করেছে । 

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে হেরা গুহায় এ ইলম লাভ করার পর তা প্রচার করার জন্য সর্বপ্রথম যে স্থানটি নির্বাচন করেন তা হল মক্কার আবু কুবাইস পর্বতে অবস্থিত বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আরকাম ইবনে আবিল আরকাম (রা.)-এর বাড়ি । ইসলামের ইতিহাসে এ বাড়িটি ‘দারুল আরকাম' বা 'দারুল ইসলাম' নামে খ্যাত । এখানেই তিনি নওমুসলিম সাহাবীদেরকে ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা দিতেন ।

মক্কার কাফেরদের অত্যাচারে বাধ্য হয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হিজরত করে মদীনায় গমন করেন, তখন তিনি সেখানে প্রথমে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন । যার নাম মসজিদে নববী । ইলমে ওহী তথা দীন প্রচারের দ্বিতীয় কেন্দ্র এটি । এখানে শিক্ষাদান কর্মসূচী আরও ব্যাপক রূপ লাভ করে । এই মসজিদে নববীতে দীনী ইলম শিক্ষা করার জন্য নিজের ঘর বাড়ি ত্যাগ করে সমবেত হয়েছিলেন বহু তালেবে ইলম । তাঁদের থাকার জন্য নির্মিত হয় মসজিদের সংলগ্ন একটি কুটির। যাকে বলা হয় 'সুফ্ফা' ।

 এখানে যেসব সাহাবী অবস্থান করতেন ইসলামের ইতিহাসে তাঁরা ‘আসহাবে সুফফা' নামে পরিচিত । তাঁরা নবীজির কাছে দীনি ইলম শিখতেন । দীন প্রচারের জন্য কোথাও কোন মুয়াল্লিম পাঠানোর প্রয়োজন হলে এখান থেকেই পাঠানো হত । রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর ‘সুফ্ফা' নামক এ মাদরাসার ছাত্রগণ ইলমে ওহীর নূর নিয়ে ছড়িয়ে পড়েন পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে । ফলে পরবর্তীতে তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন, মুহাদ্দিসীন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন, ফুকাহায়ে কিরাম তথা উলামায়ে হক্কানীর মাধ্যমে আমাদের পর্যন্ত এ ইলম পৌঁছেছে । যা বর্তমানে মাদরাসাসমূহের মাধ্যমে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে।

ভারতবর্ষে কওমী মাদরাসা ও দারুল উলূম দেওবন্দ

ভারত উপ-মহাদেশে দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর (রা.)-এর যুগেই মুসলমানদের আগমন ঘটলেও নিয়মতান্ত্রিক ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপে ভারতে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা শুরু হয় ৭০০ হিজরীর শুরুর দিকে বাদশাহ কুতুবুদ্দীন আইবেকের শাসন আমলে । ৮০০ হিজরীর দিকে ভারতে মাদরাসা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি ব্যাপক হয়ে পড়ে । সুলতান মুহাম্মদ তুঘলকের আমলে শুধু মাত্র দিল্লিতেই ১০০০ মাদরাসা ছিল । ফিরোজ শাহ মহিলাদের জন্যও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । বাদশাহ হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর, আওরঙ্গজেব তথা মোগল সম্রাটদের আমলে মাদরাসা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি এত ব্যাপক রূপ লাভ করে যে, কোন বন্দর নগর এমন ছিল না যেখানে মাদরাসা ছিল না । 

তখন পর্যন্ত মাদরাসাসমূহের ব্যায়ভার সরকারই বহন করতেন এবং প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি জায়গীরের উপর ভিত্তি করেই চলত । মোটকথা উত্তরোত্তর ইসলামী শিক্ষার ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়ে তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে আদর্শ মুসলিম জাতি গঠনে সফল অবদান রেখে আসছিল । কিন্তু ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়ে এসে সেই গতি প্রায় থেমে যায় । 

আমরা জানি, সপ্তাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে সাত শ' বছরের গৌরবময় মুসলিম শাসনের মূলে কুঠারাঘাত করে বর্বর ইংরেজ শ্বেত ভল্লুকের গোষ্ঠি বণিকবেশে এসে ছলে বলে কলে কৌশলে এ উপমহাদেশের স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে নিয়েছিল । ফলে উপমহাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে নিয়ে ধর্মীয় অঙ্গন পর্যন্ত সীমাহীন ধস নেমে আসে । তখন দূরদর্শী আলেম সমাজ ওদের উৎখাতের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। শাহ ওয়ালী উল্লাহ (র.)-এর সুযোগ্য সন্তান শাহ আঃ আযীয (র.) দ্বিধাহীন কণ্ঠে ফতওয়া ঘোষণা করেছিলেন- ‘ভারত এখন দারুল হরব বা শত্রুকবলিত। সুতরাং প্রতিটি ভারতবাসীর উপর একে স্বাধীন করা ফরয' । দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল এ ফতওয়ার ঘোষণা । 

গড়ে উঠে হযরত শাহ ইসমাঈল শহীদ, হযরত সায়্যিদ আহমদ শহীদ ও হযরত মাওলানা আঃ হাই প্রমুখের একটি বিপ্লবী জামাআত । শুরু হয় ইংরেজবিরোধী আন্দোলন । ঐতিহাসিক বালাকোট প্রান্তরে রক্তাক্ষরে নেতৃত্বে লেখা হয় তাদের নাম । 

পরবর্তীতে ১৯৫৭ সনে এসে সে আন্দোলন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন বা সিপাহীবিদ্রোহ নামে ব্যাপক রূপ ধারণ করে । এ ধারারই এক মহাপুরুষ হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহ.) নেতৃত্ব দেন প্রসিদ্ধ এই আজাদী আন্দোলনের । শুরু হয় গণআন্দোলন। কিন্তু কিছু সংখ্যক দেশীয় পদলেহী রাজন্যবর্গের বিশ্বাসঘাতকতায় সে মহান স্বাধীনতা আন্দোলন আপাত দৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়। তারপর উপমহাদেশের উপর বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের দখলকে আরো সুসংহত করে নেয় । 

নেমে আসে নেতৃত্ব দানকারী মুসলিম নেতৃবৃন্দ এবং উলামায়ে কেরামের উপর অকথ্য নির্যাতন ও নিপীড়ন । এতে গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যায় । হাজারো মানুষ হয় কালাপানির নিঃসহ অত্যাচারের শিকার । চট্টগাম থেকে খায়বার পর্যন্ত গ্রান্ড ট্রাংক রোডের দু'পাশের একটি বৃক্ষশাখাও এমন ছিল না যার মাঝে ঝুলছিলনা কোন শহীদের লাশ ।

 ইংরেজ বেনিয়ার গোষ্ঠি মুসলমানদের ধর্মীয় চেতনাকে খতম করে দেওয়ার জন্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো একে একে বন্ধ করে দেয় । এহেন অবস্থায় চরম হতাশায় মুহ্যমান হয়ে পড়ে ইসলামপ্রিয় জনতা । চারিদিকে তখন ভীষণ দুর্দিন । স্যার সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে আলীগড় আন্দোলন নামে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের তোষণ ও আপোষকামিতার সবক পড়ানো হচ্ছিল তখন । সে এক দুর্যোগময় মুহূর্তে এগিয়ে এলেন ঈমানী চেতনায় উজ্জীবিত, ওয়ালীউল্লাহী ফিকরের আলমবরদার উম্মতের কল্যাণ চিন্তায় দৃঢ় হৃদয়ের অধিকারী কাসিমুল উলূমে ওয়াল খায়রাত, হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত কাসিম নানুতবী (রহ.) ও ফকীহে উম্মত হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী ও তার সহযোদ্ধারা ।

পৃথিবীর সমগ্র পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, আন্তর্জাতিক ইসলামবিরোধী ষড়যন্ত্র ও আক্রমণসমূহের পূর্বাপর পর্যালোচনা করে নববী তালীম ও শিক্ষার আলোকে ইসলামী পুনঃজাগরণ এবং সংস্কারের এক সার্বিক কার্যকর কর্মসূচী গ্রহণ করলেন তাঁরা । এরই প্রেক্ষিতে ১৮৬৬ সনে ভারতের উত্তর প্রদেশস্থ সাহারানপুর জেলার দেওবন্দ বস্তিতে ডালিম বৃক্ষের নীচে প্রতিষ্ঠিত হয় ঐতিহাসিক এক ইলহামী প্রতিষ্ঠান । যার নাম উলূম দেওবন্দ কেবল একটি প্রতিষ্ঠান নয় বরং কুরআন-হাদীসের নিরিখে পথের একটি মানবতাবাদী বিপ্লবী বিশ্বকেন্দ্র ।

উলামায়ে কিরাম বুঝতে পেরেছিলেন যে, বর্তমানে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত করা ছাড়া দ্বীনের হিফাযত সম্ভব নয় । তাই তারা বিপুল পরিমাণে এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চিন্তা-ভাবনা অব্যাহত রাখেন । এরই ফলশ্রুতিতে ছয়মাস পর দারুল উলূমের নিসাব, আদর্শ, কর্মনীতি ও এর পৃষ্ঠপোষকতায় সাহারানপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় “মাজাহিরুল উলূম মাদ্রাসা” । তারপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন স্থানে আরো মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয় । এভাবে দারুল উলূম থেকে ফারিগ উত্তীর্ণ আলিমগণ শিক্ষা সমাপ্ত করে দেশে-বিদেশে এই কারিকুলামের অনুসরণে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার তৎপরতা শুরু করেন । ফলে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশে অসংখ্য কওমী মাদ্রাসা গড়ে উঠে এখন তো ইউরোপ-আমেরিকাতেও কওমী মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ।

দ্বীনের বলিষ্ঠ দুর্গ এ কওমী মাদ্রাসা

ইসলাম কেয়ামত পর্যন্তের জন্য আল্লাহর মনোনীত দ্বীন । তিনি নিজেই এর হিফাযতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন । ইরশাদ হয়েছে— “আমিই কুরআন নাযিল করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষক” এ অঙ্গীকারের ফলশ্রুতিতে যুগ চাহিদার প্রেক্ষিতে যুগে যুগে আল্লাহ তা'আলা এমন এমন মনীষী এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, যারা কুরআনের ধারক বাহক হয়ে দ্বীনের ইশাআত ও প্রচারের পাশাপাশি এ দ্বীনকে সর্বপ্রকার ভ্রান্তি বাড়াবাড়ি ও শত্রুছোবল থেকে হিফাযত করেছেন । এ ধারারই উত্তরসূরী হলেন, আকাবিরে কওমী মাদ্রাসা । 

হিফাযতে দ্বীনের এমন কোন ক্ষেত্র নেই, এমন কোন শাখা নেই যেখানে আমাদের আসলাফ ও আকাবিরের সরব উপস্থিতি বিদ্যমান ছিল না। ইসলাম ও মুসলমানদের উপর যেখানেই আক্রমণ হয়েছে সেখানেই তারা ব্যাঘ্রের ন্যায় বজ্র কঠিন হুংকার দিয়ে দাঁড়িয়েছেন এবং ইসলামের দুশমনদের সমস্ত ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছেন । শিখদের চক্রান্ত, হিন্দু ব্রাহ্ম্যান্যবাদীদের ছলচাতুরী, আরিয়া সমাজ ও আর্যদের ফিতনাসহ শিআ' কাদিয়ানী, বিদআতী, মওদূদী, আলীগড়ি, মাহদূবী, বাহাঈ তথা সর্বপ্রকারের ফিতনার মুকাবিলায় আমাদের আকাবির ও বুযর্গানে দ্বীন মুনাজারা ও কলমী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং হককে হক আর বাতিলকে বাতিল হিসেবে চিহ্নিত করে দিয়েছেন পরিষ্কারভাবে ।

 রাজ্যহারা মুসলমানদেরকে খ্রিস্টান বানানোর লক্ষ্যে ইংরেজ বেনিয়া গোষ্ঠী নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে উদ্যত হলে এগিয়ে আসেন মাওলানা রহমতুল্লাহ কেরানবীসহ তার আরো কতিপয় সহযোদ্ধা । মুকাবিলা হয় পাদ্রী ফান্ডারের সাথে । পরাজিত হয়ে পাদ্রী ফান্ডার রাতের অন্ধকারে হিন্দুস্তান ছেড়ে পলায়ন করে । এমনি আরো বহু ঘটনা

কওমী মাদরাসা কেমন মানুষ তৈরি করে

প্রিয় সুধী! কমযোর চারদেয়ালের এই মাদ্রাসাগুলো যুগে যুগে কেমন মানুষ পয়দা করেছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না । মাদরাসাগুলো যুগে যুগে সৃষ্টি করেছে দুনিয়ার সবচেয়ে সভ্য, ভদ্র, নম্র, চরিত্রবান খোদাপ্রেমিক, নিষ্ঠাবান, সত্যিকার দেশপ্রেমিক, দেশ জাতি ও ইসলাম রক্ষার জন্য সর্বস্ব ত্যাগে প্রস্তুত একদল নির্ভিক সৈনিক । 

যারা জাতির সর্বাধিক প্রয়োজনীয় ও মূল্যবান সম্পদ ঈমান ও ইসলামের সংরক্ষণ, বিকাশ ও প্রচারের কাজে ব্যক্তি স্বার্থকে জলাঞ্জলী দিয়ে ও জীবনের সকল চাওয়া-পাওয়া ও অভিলাষকে পিছনে রেখে অতন্দ্র প্রহরীর মত সর্বদা কাজ করে যাচ্ছেন । শুধু মুসলমান জাতিরই নয় বরং সমগ্র মানব জাতির, এমনকি পশু-পাখি ও অন্যান্য জীব-জন্তুর কল্যাণে তারা কাজ করে যাচ্ছেন । কারণ একমাত্র ইসলামী জীবনব্যবস্থায়ই মানুষসহ সকল কিছুর কল্যাণের গ্যারান্টি রয়েছে । আর কওমী মাদ্রাসাসমূহে এই কল্যাণের শিক্ষাই হাতে কলমে দেয়া হয় । আধ্যাত্মিকতার প্রাণকেন্দ্র এ কওমী মাদ্রাসা

তাহযীবে আখলাক, তাযকিয়ায়ে বাতিন তথা আত্মশুদ্ধির ক্ষেত্রেও কওমী মাদরাসার ভূমিকা স্মরণীয় । অস্বীকার করার কোন উপায় নেই । এ মাদ্রাসাসমূহে তাসওউফের বিষয়টি সর্বদাই স্বযত্নে লালিত হয়ে আসছে । ইলমের সাথে আমল, আমলের সাথে রূহানিয়্যাতের অন্যতম লালনক্ষেত্র এ কওমী মাদ্রাসা । হযরত শায়খুল হিন্দ (রহ.) মাদারে ইলমী দারুল উলূম দেওবন্দ সম্বন্ধে বলেছেন, দিনের বেলায় দারুল উলূমকে দেখা যেত জাহিরী ইম চর্চার এক শিক্ষা কেন্দ্ররূপে আর রাতের বেলা দেখা যেত এক জীবন্ত খানকা হিসেবে। 

বর্তমানে নৈতিক অবক্ষয়ের যে ধস নেমেছে তা থেকে উত্তরণের জন্য এ ব্যবস্থার কোন বিকল্প নেই । কওমী মাদরাসার মাশায়িখে কেরামই যুগে যুগে এ ধারাকে অব্যাহত রেখেছেন । তাদের এ মেহনতের বদৌলতে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, আফগানিস্তান, আফ্রিকা, আমেরিকা, লন্ডন প্রভৃতি দেশে লক্ষ লক্ষ আল্লাহপ্রেমিক ইলাহী প্রেমে মত্ত হয়ে আল্লাহু আল্লাহু শব্দের গুঞ্জরণে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুলছে ।

দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কওমী মাদরাসার অবদান

পুর্বে বর্ণিত হয়েছে, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে এ ভারত উপমহাদেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে যে আন্দোলন ও সশস্ত্র সংগ্রাম হয়েছে তাতেও ওয়ালীউল্লাহী চিন্তাধারার মানসপুত্র কওমী মাদ্রাসার উলামাদের ভূমিকা অসামান্য । বরং এ ক্ষেত্রেও তারা অগ্রনায়কের ভূমিকা পালন করেছেন । জান-দিয়েছেন, মাল দিয়েছেন, স্বজন হারিয়েছেন, বাড়ি ঘর লুট হয়েছে তথাপিও দেশকে তারা আযাদ করেছেন । রাহুমুক্ত করেছেন । 

ঐতিহাসিক মাল্টা, করাচী ও নৈতিতাল কারাগার আজও তাদের সেই রক্তস্নাত ইতিহাসকে বক্ষে ধারণ করে আছে । ঐতিহাসিক রেশমী রোমাল আন্দোলনের কথা দেশবাসী কখনো ভুলতে পারবে না । এরই ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতার সূর্য তারা ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হন । তৎকালে আকাবিরের এ আন্দোলন না হলে ভারত স্বাধীন হত না । পাকিস্তান হত না এবং পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশেরও অভ্যুদয় ঘটতো না।

সরকারী সনদ ও স্বীকৃতি কওমী শিক্ষার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নয়

কওমী মাদরাসার প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্যক ধারনা না রাখার কারণে এর শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে অনেকেই বিভিন্ন প্রশ্ন ও আপত্তি করে থাকেন । তাই এ পর্যায়ে আমরা কওমী মাদরাসার লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিঞ্চিত আলোচনা করতে পারি । যাতে সকল প্রশ্ন ও আপত্তির অবসান ঘটে এবং আমাদের দ্বীনী আত্মবিশ্বাস সুদৃঢ় ও শানিত হয় ।

প্রকৃতপক্ষে, দ্বীনী মাদ্রাসাসমূহের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল- এমন কিছু যোগ্যতাসম্পন্ন আলেম তৈরি করা, যারা কুরআন, সুন্নাহ ও এতদসংশ্লিষ্ট জ্ঞানসমূহে বিজ্ঞ ও পারদর্শী হবে ।

কওমী মাদ্রাসাসমূহের ভিত্তি ইখলাস, আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভ, আত্মত্যাগ ও দ্বীনী খেদমতের স্পৃহার উপর রাখা হয়েছে । তার মধ্যে কখনও এ বিষয়ে কথা তোলা হয়নি যে, তাদের সনদগুলো বাজারে কী মূল্য রাখবে । বরং কওমী মাদরাসার আসল লক্ষ্য হল, এখান থেকে শিক্ষা সমাপনকারী আলেমদের মধ্যে দ্বীনী ইলমের উঁচুমানের যোগ্যতা, ইত্তেবায়ে সুন্নাতের স্পৃহা, খোদাভীতি, তাকওয়া, আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ এবং দ্বীনী খেদমতের অনুরাগ কিভাবে সৃষ্টি হবে?

সুতরাং আমাদের দ্বীনী মাদ্রাসাগুলো যে ইলমের ধারক-বাহক এবং যে মন-মানসিকতার উত্তরাধিকারী, তাতে এ বিষয়টি তাদের জন্য অপমানজনক যে, তারা অন্যদের কাছ থেকে নিজেদের একাডেমিক যোগ্যতার সনদ অর্জন করার জন্য দরখাস্ত বা আবেদনপত্র নিয়ে ঘুরবে 

এই ইলমের মেজাযতো এই যে, নিজ দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করার পর আলেম ব্যক্তি নিজের ধ্যানে মগ্ন হয়ে যাবে, কারো হাজারো বার প্রয়োজন পড়বে তো সে নিজ গরজে ও নিজ প্রয়োজনে তার শরণাপন্ন হবে । 

নতুবা তার ইল্মী দক্ষতার স্বীকৃতি আদায়ের বিন্দুমাত্র প্রয়োজন নেই । আর অতীত অভিজ্ঞতা এই সাক্ষ্য বহন করে যে, যে সকল ব্যক্তি এসব মাদ্রাসা থেকে ইলমী ও আমলী যোগ্যতা অর্জন করেছেন, তাদেরকে কখনও কোথাও নিজেদের সনদপত্র দেখানোর প্রয়োজন পড়েনি এবং তাদের খেদমতের চাহিদা শুধু দ্বীনী মাদ্রাসাসমূহের মধ্যেই নয়; বরং উঁচুমানের ইউনিভার্সিটি থেকে নিয়ে সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ পর্যন্ত এত অধিক পরিমাণ রয়েছে যে, তাদের কখনো অবমূল্যায়নের অভিযোগ হয়নি ।

মাদরাসায় কেন ডাক্তারী বা ইঞ্জিনিয়ারিং সাবজেক্ট পড়ানো হয় না

অনেক সময় সমাজের নব্যশিক্ষিত সমাজ থেকে এ ধরনের প্রস্তাব আসতে থাকে যে, এ সমস্ত মাদ্রাসার সিলেবাসে ‘বিজ্ঞান' ‘গণিত' ‘ইঞ্জিনিয়ারিং' ‘ডাক্তারী’ ‘অর্থনীতি' ইত্যাদির মানসম্পন্ন শিক্ষার ব্যবস্থা হওয়া চাই । তাহলে যে সমস্ত আলেম এ সমস্ত মাদ্রাসা থেকে শিক্ষা সমাপন করে বের হবেন, তারা দ্বীনী ইলমের সাথে সাথে এ সমস্ত অভিজ্ঞতা বিষয়েও পুরোপুরি দক্ষতা ও দূরদর্শিতার অধিকারী হবেন । আবার কেউ কেউ দ্বীনী মাদ্রাসাসমূহের হিতাকাঙ্খী ও সহমর্মী হয়ে এ মতও প্রকাশ করেন যে, এ সমস্ত মাদ্রাসায় হস্তশিল্প ও অন্যান্য কারিগরি প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা হওয়া চাই । 

তাহলে যে সমস্ত আলেম এখান থেকে পাস করে বের হবেন, তারা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সমাজের বোঝা ও অন্যদের করুণার পাত্র হওয়ার পরিবর্তে নিজ যোগ্যতায় নিজের জীবনোপকরণের ব্যবস্থা করতে পারবেন এবং কোন বিনিময় ছাড়া দ্বীনের খেদমত আঞ্জাম দিতে পারবেন । এ সমস্ত মতামত যত ভাল নিয়তেই পেশ করা হোক না কেন, এটা একেবারেই অপরিণামদর্শী মত । যার ভিত্তি বস্তুতঃ দ্বীনী মাদ্রাসার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে অজ্ঞতার উপর প্রতিষ্ঠিত । কারণ পূর্বেই বলা হয়েছে, দ্বীনী মাদ্রাসাসমূহের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল- এ ধরনের যোগ্যতাসম্পন্ন উলামা তৈরী করা, যারা কুরআন, সুন্নাহ ও এতদসংশ্লিষ্ট জ্ঞানসমূহে বিজ্ঞ ও পারদর্শী হবে । 

আর এ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জন করার জন্য যে মানসিক একাগ্রতা ও পূর্ণ মনোযোগের প্রয়োজন, তাতে এক ব্যক্তি একই সময়ে উঁচুমানের যোগ্যতাসম্পন্ন আলেমে দ্বীনও হবে এবং সাথে সাথে যোগ্য ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী অথবা অর্থনীতিবিদও হবে-এটা খুবই দুষ্কর বিষয় । অধিকন্তু বর্তমান যুগে যেটাকে সর্বপ্রকার জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষের যুগ বলা হয়, এ যুগে তো এটা দিবালোকের ন্যায় ভাস্বর হয়ে গেছে যে, একই ব্যক্তির জন্য যোগ্য আলেম হওয়ার সাথে সাথে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার ও বিজ্ঞানী হওয়া সম্ভব নয়।

 কারণ, আজ যদি কোন ব্যক্তি ডাক্তারী বিদ্যাকে নিজের নির্দিষ্ট বিষয় হিসেবে নির্ধারণ করে নেয় এবং মেডিক্যাল সাইন্সে নৈপূণ্য অর্জন করে, তখন কোন বুদ্ধিমান তার সম্পর্কে এ আপত্তি করতে পারবে না যে, সে ডাক্তার হওয়ার সাথে সাথে ইঞ্জিনিয়ার কেন হয়নি? অথবা যদি কোন ব্যক্তি ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে ডিগ্রি লাভ করে, তখন তার উপর কোন বিবেকবান এ প্রশ্ন করে না যে, মেডিক্যাল সাইন্স সে কেন পড়েনি?

এমনিভাবে যদি কোন বিজ্ঞান বিষয়ক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান শিক্ষার উপর পূর্ণ জোর দেয়া হয়, তখন কোন ব্যক্তি সেখানে এ আপত্তি পেশ করে না যে, এ প্রতিষ্ঠানে সাহিত্য, কবিতা অথবা কমার্স বিষয়ের শিক্ষা কেন দেয়া হয় না । কোন কমার্স কলেজে এ প্রশ্ন করা হয় না যে, এখান থেকে ইঞ্জিনিয়ার কেন তৈরী হয় না? কোন ‘ল’ কলেজের ব্যাপারেও এ মতামত শোনা যায়নি যে, এর মধ্যে জ্যোতির্বিদ্যাও শিক্ষা দেয়া চাই ।

সুতরাং বুঝা গেল, উলামায়ে দ্বীনের নিকট ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী হওয়ার আশা করা কত ঠুনকো, অবাস্তব অযৌক্তিক ও কওমী মাদরাসার প্রকৃত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বহির্ভূত বিষয় । তবে কেউ যদ অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী হন তিনি আলেম হওয়ার পাশাপাশি কোন একটি জরুরী বিষয়ে ডিগ্রি হাসিল করতে পারেন । এতে শরীয়ত বাধা দেয় না ।

আলেমগন সমাজের বোঝা নন, করুণা ও দাতা

সমাজের কিছু অদ্ভুত ধারণা হল- আলেম উলামা সমাজের বোঝা, তাদের দ্বারা কোন উপকার নেই, তারা সাধারণ মানুষের করুণার পাত্র, তারা ইসলামের জন্য কাজ করে আবার মানুষের কাছে অর্থ-কড়ি চেয়ে বেড়ায় ইত্যাদি । এর জবাবে বলি, আমাদের সমাজে যদি কোন ব্যক্তি সমাজের অন্যান্য চাহিদাসমূহ পুরা করে কোন বিনিময় গ্রহণ করে তাহলে সে সমাজের বোঝা অথবা অন্যের করুণার পাত্রে পরিণত হয় কি না? আমরা ভালভাবেই অবগত যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি বিভাগের নিয়ম হল,

 যে ব্যক্তি যে বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করে সে সেই বিভাগে সমাজের সেবা করে, তার জীবনোপকরণও সে বিভাগের সঙ্গে জড়িত থাকে এবং যদি সে সেই বিভাগে সমাজের সেবা করার ভিত্তিতে কোন বিনিময় গ্রহণ করে, তখন তার ব্যাপারে সমাজের বোঝা বা অন্যের করুণার পাত্র হওয়ার কোন প্রশ্ন উঠে না; বরং এটা এ সমাজব্যবস্থার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, যার উপর পুরো মানবতার ভীত প্রতিষ্ঠিত 

বলে গণ্য হয় । যদি কোন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অর্থনীতিবিদ অথবা বিজ্ঞানী নিজ বিভাগে সমাজের সেবা দান করে। এবং এর ভিত্তিতে সমাজ তাকে অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদান করে, তবে এটা না তার প্রতি কোন করুণা, আর না এর দরুন এ ধারণা করা ঠিক হবে যে, সে সমাজের জন্য বোঝা বা অন্যের করুণার পাত্র।

আমি বলতে চাই, ইলমে দ্বীনের খেদমত কি সমাজের কোনো প্রয়োজনের অন্তর্ভুক্ত নয়? মুসলিম সমাজে কি এমন আলেমের প্রয়োজন নেই, যিনি তাদের দ্বীনী চাহিদাগুলো পুরণ করবেন? তাদেরকে নিত্য-নতুন সমস্যাগুলোর ক্ষেত্রে শরঈ সমাধান দিবেন? তাদের সন্তানদেরকে দ্বীনী শিক্ষা দিবেন? তাদের ভবিষ্যত ইসলামী জীবনের সংরক্ষণের জন্য নিজের পুরো জীবন ওয়াকফ করবেন? 

যিনি দ্বীনের উপর আগ্রাসী ফেতনাসমূহের কার্যকর মকাবিলা করবেন? যদি এটি একটি মুসলিম সমাজের প্রথম শ্রেণীর প্রয়োজন হয়ে থাকে তাহলে যদি সমাজ এসব খেদমতের প্রতিদান স্বরূপ এ ধরনের আলেমকে স্বীয় জীবনোপকরণের চিন্তা থেকে মুক্ত করার জন্য নিজের দায়িত্ব পালন করে, তবে এটা কোন ধরনের করুণা, যা আলেমদের উপর করা হচ্ছে এবং এ ধারণার ভিত্তিতে অবশেষে কেন এমন মানসিকতা সৃষ্টি হয় যে, তারা সমাজের বোঝা ও অন্যের করুণার পাত্র? আজ থেকে এ ধারণা পোষণ করতে হবে যে, আলেমসমাজ মসজিদ-মাদরাসা পরিচালনা করে সমাজের প্রতি বিরাট অনুগ্রহকরছেন ।

মাদরাসায় জঙ্গীবাদ শিক্ষা দেয়া হয় না, তৈরি করা হয় আদর্শ সুনাগরিক

অত্যন্ত দুঃখের সাথে আরো বলতে হয়, কিছু নব্য শিক্ষিত লোক সমাজের সবচেয়ে ভদ্র ও আদর্শ শ্রেণীর মুসলমান তথা উলামায়ে কিরামের প্রতি সমালোচনার বিষাক্ত তীর নিক্ষেপ করে । সাম্প্রতিককালে এ বিষয়টি এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, দেশী-বিদেশী, সরকারী-বেসরকারী সকল প্রচার মাধ্যম যেন উলামায়ে কেরাম ও মাদ্রাসা শিক্ষাকে কলঙ্কিত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে । 

এ সকল প্রচার মাধ্যমের কর্তা ব্যক্তি, প্রতিবেদক ও ভাষ্যকারদের যেন কোন প্রকার জবাবদিহিতার প্রশ্ন ও দায়িত্ব জ্ঞান নেই । কোন কোন পত্রিকা ও মিডিয়ার কার্যক্রমে তো স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, তারা এজন্যই নিয়োজিত । তাদের সকলের প্রায় এক দাবী যে, মাদ্রাসা শিক্ষা জাতিকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে । এ সকল প্রতিষ্ঠানে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গীবাদ শেখানো হয় (!)

আমরা এদের জবাবে শুধু এটুকুই বলতে চাই, ‘চোরের মা-র বড় গলা' কারণ আজ পর্যন্ত এ দেশে ধ্বংসাত্মক যতগুলো ঘটনা ঘটেছে, কোন একটি ঘটনার পেছনেও যথার্থ প্রমাণের ভিত্তিতে কোন মাওলানা সাহেবের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায়নি । প্রত্যেকেই নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে নিজ নিজ পরিচিত আলেমের অবস্থান নিরিক্ষণ করলে নিজেই এ কথা বলতে বাধ্য হবেন যে, আমার পরিচিত কোন মাওলানা সাহেবের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের সাথে সামান্যতম দূরেরও কোন সম্পর্ক নেই । 

বাংলাদেশের কোন একটি কওমী মাদ্রাসায়ও স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মত নৈতিকতার মারাত্মক বিপর্যয়, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী, অপহরণ ও অস্ত্র ব্যবহারের কোন ঘটনা ঘটেনি । দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র সংগঠনগুলোর অস্ত্র প্রতিযোগিতা, ও চর দখলের মত হলের সিট দখল, বিভিন্ন হল থেকে দাগী সন্ত্রাসী গ্রেফতার, বোমা তৈরীর সময় আহত হওয়া, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে অপহরণ করে হলে আটকে নির্যাতনের মাধ্যমে চাঁদা আদায় করা, কপোত-কপোতিদের নির্লজ্জ বেহায়াপনা, শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীর শ্লীলতাহানী ও জঘন্য ধর্ষকের ধর্ষণসেঞ্চুরী ও মিষ্টি বিতরণ আমাদের উচ্চ শিক্ষারই পুরস্কার (?) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নকলের সুবিধা আদায়ের জন্য শিক্ষক নির্যাতন এমন কি হোস্টেলে ছাত্রীদের হাতে শিক্ষিকা জিম্মি ও অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে পৌঁছার ঘটনাও এখন নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপর । 

সরকারী আলিয়া মাদ্রাসাও যেহেতু ব্রিটিশের মস্তিষ্কপ্রসূত তারাও স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই । এ জঘন্য অবস্থা ও পরিস্থিতির আলোচনা যদিও অনেক দীর্ঘ কিন্তু আমি সেদিকে যাচ্ছি না । আমি শুধু বলতে চাই কওমী মাদ্রাসার উপর অপবাদ দেওয়ার আগে নিজেদের চেহারা আয়নায় দেখে নেয়া উচিত ।

আপনারা জানেন কওমী মাদরাসাগুলো বিদেশী এনজিওদের অফিসের মত সুরক্ষিত কোন দুর্গ জাতীয় প্রতিষ্ঠান নয় । এগুলো জনগণের জন্য সদা উন্মুক্ত । স্থানীয় পরিষদ ও মুসল্লিদের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় এগুলোর শিক্ষাকার্যক্রম । সেখানে অস্ত্রের ট্রেনিং দেয়া হয় না । অস্ত্রের ট্রেনিং দেয়া হলে তা সকলের জানা থাকার কথা ছিল ।

পরিশেষে বলব, আমাদের দেশের সরকার প্রশাসন ও প্রচলিত শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজ যেহেতু পাশ্চাত্যের দেয়া চশমা দিয়ে দেখে এজন্য তারা কওমী মাদ্‌রাসার পিছনে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস আবিষ্কারের জন্য ব্যর্থ কোশেশ করে ।

যদি তারা সাদা চোখে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার-বিবেচনা করতে সক্ষম হয়, তাহলে তারা দেখবে যে, দুনিয়ার সবচেয়ে সভ্য, ভদ্র, নম্র, চরিত্রবান খোদাপ্রেমিক, নিষ্ঠাবান, সত্যিকার দেশপ্রেমিক, দেশ জাতি ও ইসলাম রক্ষার জন্য সর্বস্ব ত্যাগে পস্তুত একদল নির্ভিক সৈনিক কওমী মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষকরূপে জাতির সর্বাধিক প্রয়োজনীয় ও মূল্যবান সম্পদ ঈমান ও ইসলামের সংরক্ষণ, বিকাশ ও প্রচারের কাজে নিজের দুনিয়াবী সকল চাওয়া-পাওয়াকে পিছনে রেখে অক্লান্তভাবে সর্বদা কাজ করে যাচ্ছে ।

কওমী মাদরাসার প্রতি শত্রুদের শ্যানদৃষ্টি : দেশবাসী সোচ্চার হোন!

বেরাদারানে ইসলাম! বিশ্বব্যাপী ইহুদী-খ্রিস্টান ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ইসলাম ও মুসলমানদের ধ্বংস করতে এক জোট হয়েছে । একের পর এক মুসলিম রাষ্ট্র ওদের হিংস্র থাবার শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম মুসলিম দেশ হিসেবে সর্বদাই ওদের টার্গেটে । সাম্রাজ্যবাদীরা ভাল করেই জানে যতদিন কওমী মাদরাসার উলামায়ে কেরাম এ দেশে থাকবে, আর যত দিন কওমী মাদরাসা টিকে থাকবে, ততদিন এ দেশে তাদের শিকড় গাড়তে পারবে না । 

সফল হবে না তাদের কোন ষড়যন্ত্র । ইসলামী মূল্যবোধকে ধ্বংস করাও সম্ভব হবে না কিছুতেই । কেননা তারা জানে এসব আল্লাহওয়ালা তাদের রূহানী শক্তিবলে যে কোন ষড়যন্ত্র শুরু হওয়ার আগেই গন্ধ পেয়ে যান । আর দেশের ধর্মপ্রাণ জনগণ তাদের সঙ্গে থাকার কারণে তারা বাতিলের যে কোন ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান ।

তাই আলেম-উলামা ও কওমী মাদরাসাগুলোকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার ষড়যন্ত্র শুরু করে দিয়েছে। মৌলবাদী, ফতওয়াবাজ, ইত্যাদি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মাধ্যমে তারা দীর্ঘ প্রায় এক দশক যাবৎ আলেম-উলামাদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে বলতে গেলে ব্যর্থই হয়েছে । এবার তারা নতুন মিশন নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছে । এবার তারা কওমী মাদরাসাগুলো সম্পর্কে দেশের জনগণকে বিদ্রুপ ভাবাপন্ন করে তোলার এবং জনগণের কাছে আলেমদেরকে ঘৃণ্য ও ভয়ঙ্কর করে তোলার অপচেষ্টায় আদাপানি খেয়ে নেমেছে। 

নিজেদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে যত্রতত্র সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ঘটিয়ে তার দায় ভার জোর করেই কওমী মাদরাসার ঘাড়ে সোয়ার করিয়ে দেওয়ার ঘৃণ্য তৎপরতা চালাচ্ছে । ২০০৯ সালে গ্রীণ ক্রিসেন্ট নামে ভোলার একটি এনজিও অফিসে অস্ত্রসস্ত্র পাওয়া যাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিবিসি, ভয়েজ অফ আমেরিকাসহ দেশের কিছু কিছু মিডিয়া যে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে তা সত্যিই দুঃখজনক । মাদরাসা নয় এমন একটি প্রতিষ্ঠানকে মাদরাসা বলে উল্লেখ করে দেশের কওমী মাদরাসাগুলোর বিরুদ্ধে যে ভাষায় ও যে মাত্রায় বিষোদগার করা হয়েছে তা সাজানো নাটক ছাড়া আর কি বলা যায়?

সুতরাং সকল মুসলমান ভাইদেরকে সজাগ ও সচেতন থাকার আহ্বান করছি। সাম্রাজ্যবাদের দালালদের মিথ্যাচারে প্ররোচিত না হয়ে বাস্তব অনুধাবন করে নিজেদের ঈমান-আমল হিফাজত করুন । কওমী মাদরাসা ও হক্কানী রব্বানী আলেমদের সাথে সুসম্পর্ক সৃষ্টি করুন এবং একে নিজেদের পরকালীন মুক্তির জরীয়া হিসেবে গ্রহণ করুন । আল্লাহ তা'য়ালা আমাদেরকে তওফীক দান করুন । আমীন!

লেখক মাওলানা আবদুল গাফফার শাহপুরী

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন